যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলজুড়ে তাণ্ডব চালানো বেশ কয়েকটি টর্নেডো আঘাতে কেনটাকি অঙ্গরাজ্যে অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদেরা জানিয়েছেন, এই সময়ে এ ধরনের টর্নেডোর উৎপত্তি অস্বাভাবিক ঘটনা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, কেনটাকির একটি ছোট শহরে টর্নেডোর গমনপথে পড়া একটি মোমবাতি কারখানা, দমকল ও পুলিশ স্টেশন ধ্বংস হয়েছে, প্রতিবেশী মিজৌরিতে একটি নার্সিং হোম ভেঙেচুড়ে দিয়ে গেছে এবং ইলিনয়ে ই-কমার্স জায়ান্ট আমাজনের একটি গুদামের ছাদ ধসে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন।
কেনটাকির গভর্নর অ্যান্ডি বেশিয়ার জানান, এই রাজ্যের ইতিহাসে এবারের টর্নেডোগুলোই সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ছিল।
রাজ্যটির মেফিল্ড শহরে একটি মোমবাতি কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ঘটনার সময় সেখানে প্রায় ১১০ জন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৪০ জনকে উদ্ধার করা গেছে বলে বেশিয়ার জানিয়েছেন।
ওই ধ্বংসাবশেষের নিচে থেকে আর কাউকে জীবিত উদ্ধার করা গেলে তা ‘অলৌকিক ঘটনা’ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তেমনটি কখনো দেখিনি আমি। এটি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। খুব সম্ভবত কেনটাকিতে শতাধিত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।’
বেশিয়ার জানান, জরুরি উদ্ধারকাজে সহায়তা করার জন্য ১৮৯ জন ন্যাশনাল গার্ড সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে। উদ্ধার প্রচেষ্টার বড় অংশ মেফিল্ডে নিয়োজিত হবে।
কেনটাকি যেখানে ইলিনয়, মিজৌরি ও আরকানস রাজ্যের সঙ্গে মিলেছে, সেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কোণটিতেই মেফিল্ডের অবস্থান। ছোট এই শহরটিতে প্রায় ১০ হাজার লোক বসবাস করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, মেফিল্ডের কেন্দ্রস্থলের পাকা ভবনগুলো ভেঙে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, কাছে পার্ক করা গাড়িগুলো ইট ও ধ্বংসাবশেষের নিচে প্রায় চাপা পড়ে আছে।
মেফিল্ডের গ্রেভস কাউন্টির আদালত ভবনের ছাদ ভেঙে পড়েছে এবং নিকটবর্তী ফাস্ট ইউনাইটেড মেথোডিস্ট গির্জা আংশিক ধসে পড়েছে।
মেফিল্ডের দমকল প্রধান জেরেমি ক্রিয়েসন (যার নিজের স্টেশনটিই ধ্বংস হয়ে গেছে) জানান, মোমবাতি কারখানাটি গুঁড়িয়ে গিয়ে ‘লোহা, স্টিল ও মেশিনপত্রের স্তূপে’ পরিণত হয়েছে এবং উদ্ধারকারীদের কখনো কখনো ‘আহতদের কাছে পৌঁছতে নিহতদের ওপর দিয়ে ক্রল করে এগোতে হচ্ছে।’
মা জিল মনরোকে (৫২) খুঁজতে চার ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছেন কন্যা পেইজ টেইঙ্গল। তিনি জানান, তাঁর মা এই মোমবাতি কারখানায় কাজ করতেন আর শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় শেষবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল।
‘অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছি, আমরা শুধু তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি। এখানে বিপর্যয় ঘটে গেছে,’ বলেন তিনি।
রাতে ধারাবাহিক কয়েকটি বজ্রঝড় থেকে টর্নেডোগুলোর উৎপত্তি হয়। এর মধ্যে আরকানস-এর উত্তরাঞ্চলে উৎপত্তি হওয়া একটি ‘সুপার সেল’ঝড়ও ছিল। এই ঝড়টি আরকানস থেকে মিজৌরি, টেনেসি ও কেনটাকিতে প্রবেশ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসের ঝড় পূর্বাভাস কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ রজার এডওয়ার্ড বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি এগিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকটি প্রাণঘাতী টর্নেডো সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে একটি সম্ভবত অনেক দূর পর্যন্ত গেছে। প্রাণঘাতী টর্নেডোটি এর অংশ ছিল।’
নর্দান ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌগোলিক ও বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানের অধ্যাপক ভিক্টর জেনসিনি জানান, অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বছরের এই সময়ে এ ধরনের চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনার পরিবেশ তৈরি করেছে।
শনিবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এটি সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম বড় টর্নেডোজনিত বিপর্যয়। কেনটাকির জন্য একটি জরুরি অবস্থা ঘোষণার অনুমোদন দিয়েছেন তিনি।
এসব ঝড় সৃষ্টিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা খতিয়ে দেখতে এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সিকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের টর্নেডো সতর্কীকরণ পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
আরকানস-এর স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজ্যটির উত্তরাঞ্চলে মিজৌরির সীমান্তবর্তী মনেট এলাকায় টর্নেডোর আঘাতে একটি নার্সিং হোমের ছাদ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে অন্তত একজন নিহত এবং আরও পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
এর কয়েক মাইল দূরে রাজ্যটির লিচভেল এলাকায় একটি দোকান ধ্বংস হয়েছে ও একজন নিহত হয়েছেন।
ইলিনয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শুক্রবার রাতে সেইন্ট লুয়িস শহরের কাছে এডওয়ার্ডসভিলের ওপর দিয়ে টর্নেডো ও প্রবল ঝড় বয়ে যাওয়ার সময় ই-কমার্স জায়ান্ট আমাজনের একটি গুদামের ছাদ আংশিক ধসে পড়ে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন।
টেনেসিতে খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন বলে রাজ্যটির ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সির মুখপাত্র ডিন ফ্লেনার জানিয়েছেন।
মিজৌরির গভর্নর মাইক পারসন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তাঁর রাজ্যে এক শিশুসহ দুজন নিহত হয়েছেন।
মধ্যরাতের কিছুক্ষণ পর ঝড়ের মধ্যে কেনটাকির পশ্চিমাঞ্চলে একটি মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে, তবে কেউ হতাহত হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিসের ঝড় পূর্বাভাস কেন্দ্র জানিয়েছে, ইলিনয়, কেনটাকি, টেনেসি, মিজৌরি, আরকানস ও মিসিসিপি থেকে টর্নেডো হওয়ার ৩৬টি প্রতিবেদন পেয়েছে তারা।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে শনিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের এই রাজ্যগুলোর আবহাওয়া পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো থাকবে বলে জানানো হয়েছে, কিন্তু তামপাত্রা কমে যাওয়ার আভাস দেওয়া হয়েছে। ঝড়ের পর ওই অঞ্চলগুলোর হাজার হাজার মানুষ পানি ও বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছেন।
শনিবার বিকেল পর্যন্ত কেনটাকির প্রায় ৯৯ হাজার ও টেনেসির ৭১ হাজারের বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় ছিলেন।