যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও একপেশে—এটা বলার জন্য প্রমাণের অপেক্ষা করতে হয় না। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাত কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার সংবাদটি এখন বিএনপি নেতাদের মুখের একমাত্র ‘গীত’। যুক্তরাষ্ট্র যখন কিছু বলবে, তখনই বুঝতে হবে এখানে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। আজ আমরা জাতীয়-আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে যা কিছুই বলি না কেন, এটা তো চোখ বন্ধ করে বলা যায় যে, র‍্যাব কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞার জন্য নেপথ্যে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো দায়ী। পুলিশ-র‍্যাবের বিরুদ্ধে বিবৃতি ও নেতিবাচক খবর আনার জন্য তারা লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। একটি প্রবাদ আছে, যুক্তরাষ্ট্র কারও বন্ধু হলে আর শত্রুর দরকার পড়ে না। বিএনপির ‘গলগল’ভাব দেখে মনে হচ্ছে দলটি বন্ধুর সন্ধান পেয়েছে।

মানবিকতার মধ্য দিয়ে একটি দেশ ও জাতির জীবনে কীভাবে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব, তা অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন গোটা দুনিয়াকে। সারা বিশ্ব এখন অবাক যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এমন উন্নয়ন-অগ্রগতির ম্যাজিক দেখালেন কীভাবে! বাংলাদেশ আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্বের অনেক সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রনেতাও বাংলাদেশের বর্তমান বিশাল অর্জনে এখন বিস্মিত।

আমরা জানি, কোনো দেশের বাহিনীর প্রধানকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধাজ্ঞা করার ঘটনা বিস্ময়কর। ড. বেনজীর আহমেদ একসময় র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন; এখন বাংলাদেশ পুলিশের আইজি। ২০১৩ সালে হেফাজত ইসলামের ভয়ঙ্কর উসকানি, হুমকি ও মতিঝিলে গেড়ে বসার মতো অগণতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসী আচরণকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দক্ষতার জন্য যেখানে জাতি ড. বেনজীর আহমেদকে মনে রাখে, সেখানে তাঁকে বিতর্কিত করার প্রাণান্ত চেষ্টাও রহস্যজনক। আমরা সব সময়ই সুশীল সমাজের বক্তব্যকে সম্মান দিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করি। আর এটাও আমরা লক্ষ করছি, এ দেশে চিহ্নিত কিছু ‘সুশীল’ আছেন যে, তাদের একমাত্র কাজ বাস্তবতা বিচার না করে কেবল যেকোনো ইস্যুতেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে “ছোট” করার প্রাণান্তকর চেষ্টা। এখন ‘নিষেধাজ্ঞা’ খবরটিই আলোচনার বিষয় করে তোলার চেষ্টা চলছে। এটি হচ্ছে র‍্যাবের বর্তমান ও সাবেক ৬ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। তাঁদের মধ্যে সাবেক ডিজি হিসেবে আইজিপি বেনজীর আহমেদও রয়েছেন। অন্য কর্মকর্তারা হলেন র‍্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মুস্তাফা সারওয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. আনোয়ার লতিফ খান। শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রর রাজস্ব বিভাগের বৈদেশিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ দপ্তর এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই বিশেষ বাহিনীর সৃষ্টি নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই এখন এটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের হঠাৎ এই নিষেধাজ্ঞায় গণতন্ত্রকামী দেশবাসী ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত। গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করার যোগ্যতা যুক্তরাষ্ট্র রাখে কি না, এ রকম প্রশ্নও রয়েছে। প্রকাশ্যে কালোমানবদের হাঁটু গেড়ে গলা চেপে হত্যা করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে, এটা এখন আর লুকানো নয়। সেখানে ধর্ষণ-হত্যা-ডাকাতির রেকর্ড সারা বিশ্বকে ছাড়িয়ে যায়। স্কুলে ঢুকে শিশুশিক্ষার্থীদের হত্যার ঘটনা অহরহ ঘটে যে যুক্তরাষ্ট্রে, তারা বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে ভাবতে পারে কীভাবে? যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণ-লুট-খুন এমনই এক পর্যায়ে যায় যে, একেকটি রাজ্যে প্রতিদিন শত-সহস্র মামলা হয়ে থাকে। অক্টোবরে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়, ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি হেফাজতে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশের মৃত্যু ‘আনরিপোর্টেড’ অথবা ‘মিসলেবেলড’; অর্থাৎ এসব মৃত্যুর কথা ও আসল কারণ জানানো হয়নি। সেখানে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ হলেও পুলিশি হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় সাড়ে তিন গুণ।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মইন বলেছেন, র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্য নয়। র‍্যাবের মতো মানবিকতা বিশ্বের খুব কম বাহিনীই দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থান নিয়ে শনিবার র‍্যাবের প্রতিক্রিয়া জানতে চান সাংবাদিকেরা। জবাবে আল মইন বলেন, র‍্যাবের মতো মানবিকতা বিশ্বের খুব কম বাহিনীই দেখিয়েছে। র‍্যাব মানবাধিকার লুণ্ঠন করে না, মানবাধিকার রক্ষা করে। তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে যা কিছু জেনেছেন, সবই সবই গণমাধ্যম থেকে পাওয়া।

আল মইন জানান, মানবাধিকার রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‍্যাবের লে. কর্নেল আজাদসহ ২৮ জন জীবন দিয়েছেন। মানবাধিকার রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে র‍্যাবের এক হাজারের অধিক সদস্যের অঙ্গহানি হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার জন্য দুই হাজারের বেশি সদস্য বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন। র‍্যাবের মুখপাত্র আল মইন আরও বলেন, ‘বিশ্বে এমন কোনো ফোর্স নেই, যার সদস্যসংখ্যা ৯ হাজার, তাঁদের মধ্যে আমি যে পরিসংখ্যান দিলাম…দেশের আইনশৃঙ্খলা মানবাধিকার রক্ষার্থে এভাবে আত্মত্যাগ করেছে কি না, আমার সন্দেহ রয়েছে।’

বিভিন্ন বাহিনীর চৌকস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে র‍্যাব গঠিত এবং তাঁরা নির্দিষ্ট কিছু কাজ করে থাকেন। র‍্যাবের উদ্যোগে সুন্দরবন জলদস্যুমুক্ত হয়েছে। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে র‍্যাবের সম্পৃক্ততার যে অভিযোগের কথা উঠেছে, সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। আল মঈন বলেন, ‘বিভিন্ন সময় গুলিবিনিময় বা ক্রসফায়ার নিয়ে অভিযোগ ওঠে। আত্মরক্ষার অধিকার আইন দিয়েছে। মাদক ও জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে আমরা যখন প্রতিরোধের শিকার হয়েছি, যখন গুলি চালিয়েছে, তখনই আমরা গুলি করেছি। গুলি বিনিময়ে অফিসার ও বিভিন্ন সদস্য শহীদ হয়েছেন। প্রতিটি গুলিবর্ষণের ঘটনার নির্বাহী তদন্ত হয়। যদি কেউ ভুল করে থাকেন, তাহলে র‍্যাব কঠোর ব্যবস্থা নেয়। আইন ও নিয়ম ভঙ্গের বিরুদ্ধে র‍্যাবের অবস্থান কঠোর।’

এ দেশের ইতিহাস এই যে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করে একটি দেশ পাই। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ও নানা রকম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের দেশ। এই মাতৃভূমির স্বাধীনতার মূল চেতনা হলো গণতন্ত্র, সাম্য, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার। বহু ত্যাগের বিনিময়ে আমরা সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও মানবতা পেয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবতা, সাম্য, ন্যায়বিচার ধ্বংস করা হয়েছিল। গণবিরোধী জিয়াউর রহমান আর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অবৈধ সরকার কীভাবে দেশের মানুষ অর্থাৎ গোটা দেশবাসীকে এসব অধিকার থেকে লাগাতারভাবে বঞ্চিত করেছিল, সেই ইতিহাস দেশবাসীর কাছে অজ্ঞাত নয়। দেশটিকে একটি গণধিক্কৃত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন জিয়া। জিয়ার অবৈধ সরকার কীভাবে গণতন্ত্র তিলে তিলে ধ্বংস করেছিল, ইতিহাসে তা লেখা রয়েছে। বিচার করার নামে কীভাবে প্রহসন চলেছিল, তা-ও অজ্ঞাত নয়। বিচারের নামে জিয়াউর রহমান কীভাবে ফাঁসি দিয়ে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা করেছিলেন, এর ইতিহাস ভুলবার নয়। সেই দেশে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে জননেত্রী শেখ হাসিনা জীবন বাজি রেখে প্রবাস থেকে দেশে ফেরেন ১৯৮১ সালে। শুরু হয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজপথের আন্দোলন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের জনগণ যখন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারে সোচ্চার হয়, তখন জান্তা সরকার একের পর এক গণ-আন্দোলনে হত্যা চালায়। বোমা-গুলি চালায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যাচেষ্টা চালানো হয়েছিল। অপ্রতিরোধ্য জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দমাতে পারেনি শাসক দল। অবশেষে তাঁর নেতৃত্বে জনগণের ভোটে ১৯৯৬-এ সরকার গঠিত হয়। সেটি ছিল এক স্বর্ণযুগ। এরপর চক্রান্ত করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। নজিরবিহীন ঘটনা ঘটানো হয়। ২০০৪-এর ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এই নৃশংস ঘটনায় দলের নেতা-কর্মীসহ ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। তখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মানবাধিকার কোথায় ছিল?

আসলে পুলিশ-র‍্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমন বিবৃতি আনা হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।

লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক