পুলিশের হেফাজতে গ্রেপ্তার আসামিরা। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ।

কেরাণীগঞ্জের আরশীনগরে প্রকৌশলী সদরুল আলম হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন ও জড়িত সব আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

প্রকৌশলী সদরুল আলম (৪০) কেরাণীগঞ্জ মডেল থানাধীন আরশিনগর ইউনুস মিয়ার বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাট ভাড়াটে হিসেবে একা বসবাস করতেন। মাঝে মাঝে তার স্ত্রী বেড়ানোর জন্য ওই ফ্ল্যাটে এসে থাকতেন। গত ১২ আগস্ট রাত ১১টার সময় তার অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় যান। পরদিন ১৩ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে বিল্ডিংয়ের ছাদে বাড়ির মালিক মো. ইউনুস মিয়া একটি মানিব্যাগ পান। মানিব্যাগের ভিতরে সদরুল আলমের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলে তাকে জিজ্ঞাসা করার জন্য তার ঘরের সামনে গিয়ে দরজা খোলার জন্য ডাকাডাকি করতে থাকেন। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ না আসায় তিনি অন্যান্য ভাড়াটেদের নিয়ে ফ্লাটের দরজা খোলার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে শক্ত করে ছিটকিনি লাগানো থাকায় খোলা সম্ভব হয়নি । পরে উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় লোহার শাবল দিয়ে ছিটকিনি ভেঙে ফ্ল্যাটের দরজা খুললে দেখতে পান সামনে মেঝেতে সদরুল আলমের রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে আছে। ফ্ল্যাটের সব রুমের মালামাল এলোমেলোভাবে ছড়ানো-ছিটানো এবং রান্নাঘরের ভেন্টিলেটরের আশপাশের দেয়ালে পায়ের দাগ । তখন ফ্ল্যাটের মালিক জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে খবর দিলে কেরাণীগঞ্জ থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পুলিশ মৃতদেহের সুরতহাল প্রস্তুত করে লাশ ময়না তদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিডফোর্ট) হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

সুরতহাল প্রস্তুতকালে পুলিশ লাশের শরীরে ধারালো সুইচ গিয়ার চাকুর বুকে ও পিঠে ২টি রক্তাক্ত আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়।

এ ঘটনায় কেরাণীগঞ্জ মডেল থানায় সদরুল আলমের আপন বড় বোন মোসা. রেবেকা সুলতানা রত্না ১৪ আগস্ট বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

চাঞ্চল্যকর ও নৃশংস এই হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটন ও ঘটনায় জড়িত আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার জন্য ঢাকার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান তাৎক্ষনিক নির্দেশ দেন।

এরই ধারাবাহিকতায় আমিনুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম, অপস্ অ্যান্ড ট্রাফিক-দক্ষিণ) এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং শাহাবুদ্দিন কবীর বিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কেরাণীগঞ্জ সার্কেলের নেতৃত্বে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার একটি চৌকস তদন্ত টিম কাজ শুরু করে। যেহেতু প্রকৌশলী সদরুলের মৃতদেহ মৃতদেহ দরজা বন্ধ অবস্থায় ঘরের মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল এবং রান্নাঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে কেউ চুরির উদ্দেশ্যে প্রবেশ করেছে বলে মনে হওয়ায় তদন্ত টিম ভেন্টিলেটর দিয়ে বাসা-বাড়ি চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট চোরদের কার্যক্রম, পিসি-পিআর ও কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা এলাকায় সংঘটিত একই ধরনের চুরির ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত আসামিদের অবস্থান, আচরণ, গতিবিধি পর্যালোচনায় রেখে একটি গতিশীল তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। এছাড়াও তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের শনাক্তকরনের জন্য তৎপর থাকে। পরবর্তীতে তদন্ত টিম ভেন্টিলেটর দিয়ে প্রবেশ করে চুরির ঘটনার তথ্যগুলো পর্যালোচনা করে ধারণা করে ভেন্টিলেটর দিয়ে চুরি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ক্লুলেস ও নৃশংস এই হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উন্মোচিত হতে পারে।

এরই ধারাবাহিকতায় কেরাণীগঞ্জ থানার একটি আভিযানিক দল তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে গত ৩ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে আল আমিন (২২) নামে এক আসামিকে আরশিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। তার দেহ তল্লাশি করে প্যান্টের পকেটে থাকা একটি সুইচ গিয়ার চাকু পাওয়া যায়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আল আমিন জানান, তিনি একজন পেশাদার চোর। প্রতিদিন রাতে মোহাম্মদপুর থানাধীন লাউতলা এলাকা হতে তার বন্ধু শুভ ও রিমনসহ একটি ভ্যানযোগে কেরাণীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ভেন্টিলেটর দিয়ে বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন অফিসে ঢুকে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য মালামাল চুরি করেন।

তদন্তকারী টিম গ্রেপ্তার আল-আমিনকে তার দুই বন্ধু রিমন ও শুভর ব্যাপারে তথ্য জানতে চাইলে তিনি সব ধরনের তথ্য দেন এবং জানান শুভ ও রিমন প্রায় ১০ বছর ধরে ভেন্টিলেটর ভেঙে চুরি করে আসছেন।

এরপর আল-আমিনকে সাথে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করে শুভ (২৪) নামের আরেক চোরকে মোহাম্মদপুর থানাধীন লাউতলা এলাকা থেকে পায়েচালিত একটি ভ্যানসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে মোহাম্মদপুর থানাধীন চাঁদ উদ্যান এলাকা থেকে মো. রিমনকে (২৪) গ্রেপ্তার করা হয়। আলাদা-আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদে রিমন ও শুভ অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন। তারা জানান,ঘটনার দিন পায়েচালিত ভ্যান নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে তারা ৩ জন আরশিনগর এলকায় এসে উপস্থিত হন। তারা চুরি করার জন্য পাশাপাশি বিল্ডিং আছে ও সিকিওরিটি গার্ড নাই এমন বাসা খুঁজতে থাকলে তাদের চোখে ইউনুস মিয়ার বাড়িটিকে সুবিধাজনক বলে মনে হয়। ভ্যান নিয়ে রিমন অপেক্ষায় থাকেন এবং শুভ ও আল-আমিনকে বাসায় ঢোকার জন্য পাঠিয়ে দেন। বাসার পিছন দিকের সরু রাস্তা দিয়ে আল-আমিন ও শুভ দুই বিল্ডিংয়ের মাঝামাঝি আসলে শুভ আল-আমিনকে বিল্ডিংয়ের সানশেডের ওপর উঠিয়ে দেন। আল-আমিন উপরে উঠে গেলে নিচে শুভ অপেক্ষা করতে থাকেন। এভাবে ৩০/৪০ মিনিট পার হলে আল-আমিন উপর থেকে নিচে নেমে শুভকে বলতে থাকেন দ্রুত পালাতে হবে, কারণ বাসার ভেন্টিলেটর দিয়ে ভিতরে ঢুকলে বাসার মালিক ঘুম থেকে উঠে তাকে ধরে ফেলেন। এ সময় আল আমিন তাকে সুইচ গিয়ার চাকু দিয়ে দুইবার আঘাত করেন।তারপর তারা তিনজন একত্রে দ্রুত মোহাম্মদপুর এলকায় চলে যান।

শুভ ও রিমনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রথমে আলাদাভাবে আল-আমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সবকিছু অস্বীকার করলেও তিনজনকে একত্রিত করে জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসে। গ্রেপ্তার আসামিদের বিরুদ্ধে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় চুরি ও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। মামলাটির তদন্ত অব্যাহত আছে।