এই শ্যালো মেশিন ঘর থেকে উদ্ধার হয় ইয়াবা কারবারি ফরিদউদ্দিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ।

টাঙ্গাইলে চাঞ্চল্যকর ইয়াবা কারবারি ফরিদউদ্দিন হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটনসহ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে জেলা পিবিআই।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার ভারড়া ইউনিয়ন এলাকা থেকে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা আনুমানিক ৩টার সময় টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানাধীন বীর সলীল এলাকায় স্যালো মেশিন ঘরে ফরিদউদ্দিনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে মর্মে খবর পাওয়া যায়।

খবর পেয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সিরাজ আমীনের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক একেএম আলীনূর হোসেন, পিপিএমের নেতৃত্বে একটি চৌকস টিম দ্রুততার সাথে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে নাগরপুর থানা পুলিশকে আইনি সহায়তা দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে ছায়া তদন্ত শুরু করে।

পিবিআই টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারে যে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর মো. ফরিদ উদ্দিন (৪৫) নিজ বাড়ী থেকে বের হয়ে জমিতে পানি সেচ দেওয়ার জন্য তার নিজস্ব স্যালো মেশিন ঘরে যান। পরদিন বেলা আনুমানিক ১২টায় ওই মেশিন ঘরের পাশের জমিতে তার চাচাতো ভাই মধু মিয়া ও প্রতিবেশী পান্নু মিয়া কাজ করার সময় শ্যালো মেশিন ঘর তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পাযন। ফরিদ উদ্দিনের পালিত কুকুরকে মেশিন ঘরের চারপাশে বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করতে দেখে ঘোরাঘুরি করতে দেখে মধু মিয়া ও পান্নু মিয়া মেশিন ঘরের দিকে এগিয়ে যান। তারা সেখানে গিয়ে মেশিন ঘরের বেড়ার কাটা অংশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখে যে, মেশিন ঘরের ভিতর চৌকির উপরে ফরিদ উদ্দিন উপুর হয়ে পড়ে আছেন। তারা ফরিদ উদ্দিনকে অনেক ডাকডাকি করলে তার কোনো সাড়া না পেয়ে তার বাড়িতে খবর দেযন। এরপর ফরিদ উদ্দিনের বাড়ির লোকজন এসে শ্যালো মেশিন ঘরের তালা ভেঙে তাকে মৃত অবস্থায় পায়।

নাগরপুর থানা পুলিশ মৃতের সুরতহাল রিপোট প্রস্তুত করার সময় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন পায়। তার হাত, পা, মুখ বাঁধা ছিল। এ ঘটনায় ফরিদ উদ্দিনের স্ত্রী শারমিন সুলতানা ওরফে লিলি (৩৯) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে নাগরপুর থানায় হত্যা মামলা করেন।

হত্যা মামলাটি পিবিআইর সিডিউলভুক্ত মামলা হওয়ায় ঢাকায় পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সের মাধ্যমে পিবিআই টাঙ্গাইল জেলা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে পিবিআই টাঙ্গাইল জেলার একটি চৌকস টিম ফরিদ উদ্দিনের হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য ছায়া তদন্ত অব্যাহত রেখেছিল। মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআই টাঙ্গাইল জেলার টিম প্রথাগত তদন্তের পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মামলাটির রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রাখে।

বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ভিকটিম ফরিদ উদ্দিন হত্যার ঘটনায় জড়িত ও ঘটনার পর থেকেই পলাতক আসামিদের অবস্থান নির্ণয় করে গতকাল সন্ধ্যায় ও রাতে সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে মো. অলি তালুকদার (১৯), মো. কামাল হোসেন (২৯) ও মো. সোহানুর ইসলাম ফারদিনকে (২০) টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন থানা এলাকা হতে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা ফরিদ উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন এবং হত্যাকাণ্ডের বিশদ বর্ণনা দেন।

তাদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, ফরিদ উদ্দিন নিজে ইয়াবা সেবন করতেন এবং আশপাশের এলাকার অন্যান্য ইয়াবা আসক্তদের কাছে ইয়াবা বিক্রি করতেন।
ঘটনার দিন ওই তিন আসামির ইয়াবা সেবনের ইচ্ছা হলে, তাদের কাছে নগদ টাকা না থাকায় রাত আনুমানিক ১১টার দিকে ফরিদ উদ্দিনের কাছে বাকিতে ইয়াবা কিনতে আসেন। এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার ফরিদ উদ্দিনের কাছ থেকে বাকিতে ইয়াবা কিনেছিলেন। কিন্তু তারা সময় মতো ইয়াবার টাকা পরিশোধ করেননি। তাই ঘটনার দিন ফরিদ উদ্দিনের কাছে ইয়াবা ট্যাবলেট থাকা সত্ত্বেও তাদের কাছে বাকিতে ইয়াবা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানান। তখন আসামিরা তিনজনেই ফরিদ উদ্দিনের উপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যান এবং যেকোনভাবে তার কাছ থেকে ইয়াবা পেতে চান। কিন্তু ফরিদ উদ্দিন নাছোড়বান্দা, তিনি কোনোভাবেই বাকিতে ইয়াবা বিক্রি করবেন না মর্মে সাফ জানিয়ে দেন। এক পর্যায়ে আসামিরা ইয়াবা পাওয়ার জন্য ফরিদ উদ্দিনের সাথে তর্ক বিতর্ক, ঝগড়াঝাটি ও মারামারি শুরু করেন। তারা নেশার টানে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ইয়াবা পাওয়ার জন্য ফরিদ উদ্দিনের মুখ, হাত, পা বেঁধে মেশিন ঘরে থাকা স্লাই রেঞ্জ দিয়ে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এরপর কাছে থাকা ইয়াবা নিয়ে পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়ার আগে ফরিদউদ্দিনের মৃতদেহ কাঁথা দিয়ে ঢেকে মেশিন ঘর বাহির থেকে তালাবদ্ধ করে চাবি অজ্ঞাত স্থানে ফেলে যান ।

ফরিদ উদ্দিন এবং গ্রেপ্তার সন্দেহভাজন আসামিদের বাড়ি একই এলাকায় এবং তারা পরষ্পর পূর্ব পরিচিত। বেশ কিছুদিন যাবত আসামিরা ফরিদ উদ্দিনের কাছ থেকে নিয়মিত ইয়াবা কিনতেন। মাঝে মধ্যে তারা ফরিদ উদ্দিনের মেশিন ঘরে বসে আসামিরা ইয়াবা সেবন করতো। ইয়াবা সেবন এবং কেনাবেচা নিয়ে ইতোপূর্বে তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল মর্মে আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়।

ফরিদ উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের মাত্র তিন দিনের মধ্যে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিরা গ্রেপ্তার হওয়ায় ভিক্টিমের পরিবারসহ এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে পিবিআইর কর্মতৎপরতায় সন্তোষ ও স্বস্তি বিরাজ করছে।