রোববার (২৩ জানুয়ারি) রাজবারবাগ পুলিশ লাইনসে আয়োজিত ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০২২’ এর অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ গড়া গর্বিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পুলিশ। জাতির যে কোনো প্রয়োজনে সবার আগে গণমানুষের সেবা, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছে এই বাহিনী। এই বাহিনী আজ সগৌরবে দেশের সেবা করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পুলিশের অগ্রযাত্রার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। নানা সময়ে অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে এই বাহিনীকে যেতে হয়েছে। তবে সেই সমস্যা সংকুল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি বারই বাংলাদেশ পুলিশের ত্রাতা হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলমান পুলিশ সপ্তাহে তাঁর অবদানের কথা তাই ঘুরেফিরে সবার মনে আসছে।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই ‘জনবান্ধব পুলিশ’ হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশকে গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নতুন ইউনিট স্থাপন, বাজেট বাড়ানো, রেশন ব্যবস্থার সংস্কার করেন তিনি। পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ পুলিশকে ৫ কোটি টাকা সিড মানি প্রদান করেন।
২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ পুলিশকে গণমানুষের সেবায় আরও বেশি সুদক্ষ করতে নতুন নতুন পুলিশ ইউনিট স্থাপন, জনবল বৃদ্ধি, পুলিশে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, বিভিন্ন ধরনের পুলিশ প্রশিক্ষণ ইউনিট স্থাপন, বাজেট ও লজিস্টিকস সুবিধা বৃদ্ধি, বিদেশে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেন।

পুলিশের উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যক্রম

২১১টি নতুন থানা ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্নকরণ, ৯৫টি থানাকে মডেল থানায় উন্নীতকরণ, ২১টি পুলিশ ব্যারাক, ৬০টি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, ১৯টি অস্ত্রাগার, ৯টি পুলিশ সুপার কার্যালয়, ৪৫টি পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্প্রসারণ, ২৪টি সার্কেল এএসপি অফিস কাম বাসভবন, ৪০টি হাইওয়ে আউটপোস্ট, ৮টি হাসপাতাল, ৬০৪টি আবাসিক ফ্ল্যাট, ২৫টি নারী ব্যারাক, ৯টি অ্যাকাডেমিক ভবন, ৯৬টি প্রশাসনিক ভবন, ২৫টি পুলিশ ফাঁড়ি, ৭৮০টি স্থানে সীমানা প্রাচীরসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, ৭টি ডরমিটরি, ১৭টি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি, ১টি ট্রেনিং স্কুল, ১টি প্রশাসনিক ভবন, ১টি প্রশাসনিক ভবনের সম্প্রসারণ কাজ, ৭টি র‍্যাব কমপ্লেক্স ভবন, ৬টি ট্রেনিং সেন্টারের আধুনিকায়ন, ২টি ফরেনসিক ও ডিএনএ ল্যাব, ১টি সাইবার ক্রাইম সেন্টার, ১টি আইটি সেন্টার, পুলিশ কন্ট্রোল রুমের আধুনিকায়ন কাজ সম্পন্নকরণ এবং পুলিশের সাড়াদান দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে ২ হাজার ৭৭৮টি যানবাহন প্রদান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনবদ্য অবদানের অংশ।

এর বাইরে ১০৪টি নতুন থানা, ৬৬টি ব্যারাক, ৪১টি নারী ব্যারাক, ৮০টি ফাঁড়ি, ২৯টি তদন্ত কেন্দ্র, ৭৫টি প্রশাসনিক ভবন এবং ৩৩৭টি থানায় হেল্প ডেস্ক, ১০টি হাইওয়ে আউটপোস্ট, ৫টি হাসপাতাল, ৬টি ডরমিটরি, ২টি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি, ১টি ট্রেনিং স্কুল, ৬টি পুলিশ লাইনস, ১টি প্রশাসনিক ভবন, ১টি প্রশাসনিক ভবনের সম্প্রসারণ কাজ, ৫টি র‍্যাব কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ ও ৭৮৩টি যানবাহন ক্রয়ের কাজ চলমান রয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশকে ত্রি-মাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ পুলিশ এমআই-১৭১ এ ২ মডেলের দুটি হেলিকপ্টার ক্রয়ের জন্য রাশিয়ার জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টারসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আশা করা যাচ্ছে, এক বছরের মধ্যেই হেলিকপ্টার দুটি বাংলাদেশ পুলিশের বহরে যুক্ত হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে পুলিশের অনুপাত ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে নতুন নতুন পদ সৃজন করেছেন। তাঁর সরকারের ২০০৯ থেকে ২০১৩ মেয়াদে বাংলাদেশ পুলিশে ৩৩ হাজার ১০২টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁর ঘোষিত ৫০ হাজার জনবল বৃদ্ধির পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশে ৪৯ হাজার ৫০৫টি নতুন পদ বাংলাদেশ পুলিশে সৃষ্টি করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে ১৭৮টি পদ সৃজন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পুলিশের জন্য ধারাবাহিকভাবে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পুলিশের বাজেট প্রায় ৪ দশমিক ৭১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের কল্যাণে ‘কমিউনিটি ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশের এই ব্যাংকটি প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তি দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৭ সালে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের জন্য ১০ তলা ভবন নির্মাণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি প্রদান এবং চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের বেড সংখ্যা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, চিকিৎসা সংক্রান্ত অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেন।
পুলিশ সদস্যদের বিদ্যমান রেশন ব্যবস্থার সংস্কার ও দুই সদস্যের আজীবন রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অনুগ্রহে পুলিশ সদস্যদের কল্যাণে করোনাকালে পুলিশ হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি একটি প্রাইভেট হাসপাতাল ভাড়া করে করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।

এ ছাড়াও সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে পুলিশ সদস্যদের বিদ্যমান ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং নতুন নতুন ভাতা প্রচলন করা হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ(আইজিপি), বাংলাদেশ  ড. বেনজীর আহমেদ, বিপিএম (বার)-এর উদ্যোগে গত ৪০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পুলিশের নিয়োগবিধিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবর্তিত নতুন এই নিয়মে ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণ মেধা, যোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও দুর্নীতিমুক্তভাবে সারা দেশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। ক্যাডেট সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিয়োগ চলমান রয়েছে এবং দ্রুতই সার্জেন্ট পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও সাহসী সমর্থনে জঙ্গিবাদকে দমন করে বাংলাদেশ পুলিশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। জঙ্গিবাদ দমন ও প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম নামে পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিটও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান সরকারের সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জঙ্গিবাদ দমন ও প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকার জন্য এই ইউনিটটি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়াও সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ পুলিশের অপর আরেকটি ইউনিট অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) গঠন করা হয়েছে। এই ইউনিটটি দেশের যে কোনো প্রান্তে ঘটতে যাওয়া সন্ত্রাসবাদ দমনে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন এখন দস্যুমুক্ত। নৌ-পুলিশ দেশের মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণে জোরালো ভূমিকা রেখে চলছে, এর ফলশ্রুতিতে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শিল্পাঞ্চল পুলিশ বাংলাদেশের শিল্প খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষ রোধ এবং মালিক ও শ্রমিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে জোরালো ভূমিকা রাখার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির লাইফলাইনকে সমুন্নত রেখে চলছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারের সময়ে প্রতিষ্ঠিত হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মূলমন্ত্রকে ধারণ করে দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলছে। মহাসড়ককে অপরাধমুক্ত রাখার রাখার পাশাপাশি যান চলাচল স্বাভাবিক রেখে দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে নিরাপদ করতে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।
পর্যটন এলাকার নিরাপত্তা ও আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চালু হওয়া টুরিস্ট পুলিশ পর্যটকদের কাছে এক আস্থার নাম। বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটটি প্রতিটি টুরিস্ট স্পট ও আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলছে। এ কারণে মানুষ নিশ্চিন্তে বিভিন্ন পর্যটন স্পটে বেড়াতে যেতে পারছেন, যা সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রেখে চলছে।

বাংলাদেশ পুলিশের তদন্তে নিয়ে কাজ করে বিশেষায়িত ইউনিট পিবিআই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত একটি পুলিশ ইউনিট। বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিটটি গভীরভাবে তদন্ত কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক অমীমাংসিত মামলার রহস্য উন্মোচন করেছে পিবিআই। তদন্তের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত ইউনিট হিসেবে পিবিএই ইতিমধ্যেই গণমানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিট এপিবিএন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুলিশের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে বিপিএসহ সব পুলিশ প্রশিক্ষণের ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। অতিরিক্ত আইজিপি পর্যন্ত সব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছে। বিদেশ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে।

দেশের সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত নিরাপদ পরিবেশ ও স্থিতিশীল পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দিনে দিনে পেশাদারি, কর্মনিষ্ঠা, দেশের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যাশিত ‘জনগণের পুলিশ’ হওয়ার পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ পুলিশ।

শেখ আব্দুল্লাহ আল নোমান লেখক ও সাংবাদিক