সবাই যখন ঈদের জামাতে, তখন পুলিশ সদস্যদের তাদের পাহারায় নিয়োজিত থাকতে হয়। ছবি: সংগৃহীত

পুলিশ সদস্য আব্দুল মোমিন। জাতীয় ঈদগাহে ঈদের জামাতে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন, যেন কারও নিরাপত্তায় হুমকি না আসে। সকাল সাতটা থেকে তাঁর ডিউটি। ঈদের দিন বলে আয়েশ করে ঘুমানোর সুযোগ নেই। ভোরে ঘুম থেকে উঠে গোসল করে নিত্যদিনের পোশাক পরেই তৈরি হতে হয়েছে ঈদগাহে আসার জন্য। তবে নামাজ পড়তে নয়। সবাই যখন নামাজ পড়েন, তখন অস্ত্র হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন আব্দুল মোমিন। আর সবার মতো তাঁরও স্বজনের জন্য মায়া আছে, আছে কাছে যাওয়ার আকুতি, আছে একসঙ্গে বসে ভালো কিছু খাওয়ার বাসনা। কিন্তু কী আর করা, পেশাটাই এমন যে এখানে আবেগের কোনো স্থান নেই।

পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)-তে কাজ করেন বেলাল হোসেন। ঈদের দিন দায়িত্ব পড়েছে গণভবন এলাকায়। সাদাপোশাকে নিবিড় নজরদারির দায়িত্ব পালন করছেন। স্ত্রী, সন্তান আছেন গ্রামের বাড়িতে। অভিমানী সন্তানকে কীভাবে মানাবেন, তা জানেন না তিনি।

এ রকম গল্প প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার ১৬৩ জন পুলিশ সদস্যের, যাঁরা অন্যের ঈদ নির্বিঘ্ন করতে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। কেউ সড়ক, নৌ ও রেলপথে, কেউ ঈদগাহ মসজিদে, কেউ মার্কেট শপিং মলে, কেউ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়, কেউ অপরাধী ধরতে কিংবা অপরাধ ঠেকাতে দায়িত্ব পালন করছেন। মূলত মানুষের নিরাপত্তা দেওয়াটাই তাঁদের কাছে মুখ্য বিষয়। আর নিজের ও পরিবারের আনন্দ অনেকটাই গৌণ। তখনই ভালো লাগে যখন তাঁদের কাজে জনগণ সন্তুষ্ট হয়। তখনই নিজেকে সার্থক মনে হয়। চাকরি জীবনের শুরুতে পারিবারিক পরিবেশের জন্য হয়তো মন খারাপ হয়, কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সব সয়ে যায়।

সারা দেশ যখন করোনা ক্রান্তিকালে উৎসবমুখর ঈদের আনন্দে ভাসছে, পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ছুটছে নাড়ির টানে; ঠিক এমনই সময়ে মান্যবর ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি), বাংলাদেশ ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) মহোদয়ের নির্দেশনায় দিনে ও রাতে ব্যস্ত বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিটি ইউনিটের সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করার প্রয়াসে। সবাই যখন ঈদ আনন্দে ব্যাকুল, চারদিকে কেনাকাটার ধুম, আপনজনের কাছে ফেরার জন্য করছে প্রাণান্ত চেষ্টা; একই সময়ে তাঁদের আনন্দকে নির্বিঘ্ন করতে নিজেদের পরিবার-পরিজনকে দূরে রেখে সহাস্য বদনে সেবা প্রদানে (সার্ভিস উইথ স্মাইল) সচেষ্ট বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা।

শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, প্রগতি-এর মূলমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ পুলিশের সেবাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং করোনাকালীন সম্মুখ যোদ্ধা বাংলাদেশ পুলিশের অকুতোভয় সদস্যদের চব্বিশ ঘণ্টার সতর্ক চোখ আর চেষ্টাতেই জনসাধারণের স্বাভাবিক আর নিরাপদ জীবন যাপন সম্ভব। আর এ কারণেই সকলের মতো ঈদ পার্বণ আসে না পুলিশের জীবনে।

‘স্থানীয় মানুষের সক্রিয় সমর্থন নিয়ে দেশের আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে, সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, অপরাধের ভয় কমাতে, জননিরাপত্তা বাড়াতে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’—পুলিশের এই মিশনকে অটুট রেখে বাংলাদেশ পুলিশের সকল ইউনিট-রেঞ্জ/জেলা পুলিশ, মেট্রোপলিটন পুলিশ, বিশেষ শাখা (এস. বি), সিআইডি, এপিবিএন, হাইওয়ে পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, পিবিআই, প্রশিক্ষণ একাডেমি/কেন্দ্র, অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের সদস্যগণ অঞ্চলভিত্তিক নিজ নিজ ইউনিট প্রধানগণের নির্দেশনায় ইউনিফর্মে এবং সাদাপোশাকে সুচারুরূপে দায়িত্ব পালন করছেন।

সড়ক ও মহাসড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশ; প্রধান প্রধান বাস স্টেশন, ট্রেন স্টেশন ও নৌ বন্দরে পাহারায় পুলিশ; বাসস্থান, শপিং মল, মার্কেট, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ট্যুরিস্ট স্পটের নিরাপত্তায় পুলিশ; চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, জাল টাকা, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ সংঘবদ্ধ অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশ; গার্মেন্টস, শিল্প কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বেতন-বোনাসের সমন্বয় সাধনে পুলিশ; বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিঘ্নকারী তথ্য, গুজব, পোস্ট, মন্তব্যের আলাকে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ; জঙ্গি, সন্ত্রাসী, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড রোধে পুলিশ; রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, স্থাপনা, আদালত প্রাঙ্গণ, গার্ড, কেপিআই নিরাপত্তায় পুলিশ; বড় ধরনের আর্থিক লেনদেন ও অর্থ পরিবহনের নিরাপত্তায় পুলিশ।

বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণ চব্বিশ ঘণ্টাই মাঠে থাকবেন—এটাই স্বাভাবিক। কারণ, পুলিশ আইন, ১৮৬১ (১৮৬১ সালের ৫ নং আইন)-এর ২১ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘এই আইনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক পুলিশ কর্মচারী সর্বদা কার্যে রত (অন ডিউটি) বলিয়া বিবেচিত হইবে এবং যেকোনো সময় জেলার যেকোনো স্থানে তাহাকে পুলিশ অফিসার হিসাবে নিযুক্ত করা যাইবে।’

কিন্তু, কখনো ক কেউ অনুভব করেন, নীলাভ মোটা পোশাকের আড়ালেও রয়েছে একটি রক্তমাংসে গড়া শরীর। সেখানে সাধারণ মানুষের মতোই রক্তের ধারা প্রবাহিত হয়। সে রক্তেও আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে, আছে সীমাহীন দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার। জীবনের সোনালি দিনগুলো এভাবেই চলে যায়। পুলিশ ভুলে যায় প্রিয়জনদের ঘিরে বিভিন্ন উৎসবমুখর দিনগুলোর কথা। একগুচ্ছ মান-অভিমান সামলে প্রতিশ্রুতি দেয় পরবর্তী উৎসবে জন্মদাতা বাবা, গর্ভধারিণী মা, প্রিয়তমা স্ত্রী আর স্নেহের সন্তান নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে আকাশ-বাতাস ছন্দময় করে তুলবেন।

মানুষের নিরাপত্তাই তাঁদের কাছে আনন্দের। সবাই যখন ঈদের জামাতে, পাশেই দাঁড়িয়ে তাঁরা সতর্ক অবস্থায়। সবাই যখন ঈদের আনন্দে মত্ত, তখন তাঁরা মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত। ঈদের নতুন পাঞ্জাবি কিংবা জামাটাও হয়তো রয়ে গেছে ব্যারাকের ট্রাঙ্কেই। সেদিকে তাকানোর ফুরসত কোথায়!

নিরাপত্তা সবার আগে
প্রতিবারের মতোই এবারও সেই একই লক্ষ্য নিয়ে ঈদের দিনগুলোতে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী কিংবা পরিবার-পরিজনের স্নেহ, মমতা আর ভালোবাসা বঞ্চিত পুলিশ সদস্যরা ঈদ আনন্দ উপভোগ করছেন সাধারণ মানুষের ঈদ আনন্দের মাঝেই। তাঁরা মনে করেন, পেশাটাই সবচেয়ে আগে—এ পথচলাতেই আনন্দ।