বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছেন, আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে দেশের অর্থনীতিতে ‘ভালো খবর’ আসছে।

বৈশ্বিক সংকটে নানামুখী চাপের মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই আশার বাণী শুনিয়েছেন তিনি। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া সাম্প্রতিক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে রউফ তালুকদার বলেন, চাহিদা নিয়ন্ত্রণে আমদানি পর্যায়ে কড়াকড়ি ও নজরদারি বাড়ানোয় জুলাই মাসে আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, কয়েক মাস ধরে যা ৭-৮ বিলিয়নের ঘরে ছিল। এভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুফল আগামী ২-৩ মাসের মধ্যেই অর্থনীতিতে ভালো খবর আনবে।

চাহিদা নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা ও ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণ মূলত বৈশ্বিক সংকট। আমদানি খরচ কমিয়ে আনতে ৩০ লাখ ডলারের বেশি অর্থের এলসি খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংক আগাম তথ্য নিচ্ছে। তাতে বেশ কিছু এলসি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স সেই হারে না বাড়ায় দেখা দিয়েছে সংকট। ডলারের বিনিময় হার পৌঁছেছে রেকর্ড পর্যায়ে।

বিনিময় হার নিয়ে গভর্নর বলেন, “স্বল্প সময়ের মধ্যে ডলার আয় ও খরচ হয়ে যায়। তার ওপর ভিত্তি করেই দর নির্ধারণ হচ্ছে।”

এদিকে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আনায় জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমেছে, যেখানে আগের মাসে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

ডলার সরবরাহ বাড়াতে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগে সুফলও মিলতে শুরু করেছে। গত জুলাইয়ের শেষে দেশের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ, আর রেমিট্যান্সে হয়েছে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শ্রেণীকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশনিং; এই চার চলক নির্ধারণ করে ১০ দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করার কথাও জানান গভর্নর।

এক প্রশ্নের ‍উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘চিহ্নিত দুর্বল ব্যাংকগুলোর সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক ওয়ান-টু-ওয়ান ভিত্তিতে আলোচনা কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো একটি তিন বছর মেয়াদি ‘বিজনেস প্ল্যান’ দেবে, যার অগ্রগতি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যবেক্ষণ করবে।’’

তবে ব্যাংকগুলোর নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, ‘১০ ব্যাংকের নাম না বলাই ভালো…দুটি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বাকিগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে বৈঠক করা হবে। আমাদের মনে হয়েছে, তাদের সাপোর্ট দরকার। আমরা চাই তারা ভালো করুক, সবল হোক, ভালো ব্যবসা করুক, বিনিয়োগকারীরা যেন ভালো ডিভিডেন্ড পায়।’’

রউফ তালুকদার বলেন, ৯ শতাংশে বেঁধে দেওয়া ব্যাংকঋণের সুদহারে পরিবর্তন আনার কোনো পরিকল্পনা নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের। ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে।

অর্থনীতি যে চাপের মুখে আছে, সে কথা স্বীকার করে গভর্নর বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো সার্বিকভাবে মানি সাপ্লাই (অর্থ সরবরাহ) কম; অন্যান্য দেশে যেখানে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৮৮ থেকে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত, সেখানে আমাদের দেশে ৪২-৪৩ শতাংশ। মানি সাপ্লাই কম হওয়ার কারণে ব্যাংক খাতে তারল্যের ক্রাইসিস দেখা দেয়। আমরা এখন সুদহার বাড়ালে বেসরকারি খাতে মানি সাপ্লাই আরও কমে যাবে। আমরা মানি সাপ্লাই বাড়ানোর পক্ষে।’

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ব্যাংকে ‍সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাংকারদের আরও নিয়ম মেনে চলতে বাংলাদেশ ব্যাংক সহযোগিতা করবে। কোথাও ব্যত্যয় হলে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক দ্রুত ‘অ্যাকশনে যাবে’।

ব্যাংক খাতে ‘প্রভাবশালী মহলের দৌরাত্ম্য’ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে আব্দুর রাউফ বলেন, ‘সবাই ক্ষমতাবান। কে কোন ব্যাংকের মালিক, আমরা দেখব না। দেখব কে নিয়ম মানছে, আর কে মানছে না। যে মানবে না…সে যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা চাই সব ব্যাংক ভালো ব্যবসা করুক।’

২০২৬ সালে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের প্রসঙ্গ ধরে গভর্নর বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতকেও সেই মানদণ্ডে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এখনো অনেক ব্যাংক বিদেশে সরাসরি এলসি খুলতে পারে না। অন্য ব্যাংকের গ্যারান্টি নিতে হয়। মূলধন বেশি হলে এই সমস্যাও কেটে যাবে।’

গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতেও তদারকি বাড়ানোর কথা বলেন গভর্নর।