অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার)। ছবি : বাংলাদেশ পুলিশ

ট্যুরিস্ট পুলিশপ্রধান অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নতুন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বর্তমান কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বিপিএম (বার), পিপিএম-এর স্থলাভিষিক্ত হবেন তিনি।

বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব সিরাজাম মুনিরা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাঁকে ডিএমপি কমিশনার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৬৭ সালের ১ জানুয়ারি গোপালগঞ্জের চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন হাবিবুর রহমান। শৈশব থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।

তিনি ১৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। চাকরি জীবনে যে কর্মস্থলেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই রেখে এসেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল চিন্তাচেতনা আর ব্যতিক্রমী কর্মস্পৃহার স্বাক্ষর। নেতৃত্ব আর সৃজনশীলতা দিয়ে প্রশিক্ষণকালেই ‘আমার হলো শুরু’র সম্পাদক নির্বাচিত হন। ডিএমপির ডিসি (হেডকোয়ার্টার্স) হিসেবে কর্মরত অবস্থায় মেধা ও নেতৃত্ব গুণে তিনি সাধারণ মানুষ, সহকর্মী ও অধস্তন পুলিশ সদস্যের কাছে হয়ে উঠেন মানবিক পুলিশি সেবার উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশ স্বীকৃতি পায় তাঁর অনন্য উদ্যোগের মাধ্যমে। ডিসি হেডকোয়ার্টার্স থাকাকালে তিনি বাংলাদেশ পুলিশের বাস্কেটবল এবং কাবাডি টিমের দায়িত্ব গ্রহণ করে পুলিশ টিমের খেলায় প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনেন।

হাবিবুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে অভিনব কর্মকৌশল প্রয়োগ করেন। তিনি সাধারণ মানুষকে পুলিশের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জনগণের পুলিশ’ হিসেবে পুলিশকে চিত্রিত করেন।

অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে সফলভাবে কাজ করার পর ডিআইজি হিসেবে ঢাকা রেঞ্জে যোগ দেন হাবিবুর রহমান। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে করোনাকালে সমাজের নিম্নস্তরের ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের সহায়তা, পুলিশ নিয়োগ ও পদায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, জনগণকে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করা, মনিটরিং সেল স্থাপনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ঢাকা রেঞ্জ পুলিশকে অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যান।

দীর্ঘ তিন বছর ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে তিনি অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ট্যুরিস্ট স্পটে নিরাপত্তা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। পেশাগত জীবনে তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য যেমন লাভ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, তেমনি অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং দুবার প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদকে (পিপিএম) ভূষিত হয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

‘মানবিক পুলিশ অফিসার’ হিসেবে পরিচিত হাবিবুর রহমানের উদ্যোগে বদলে গিয়েছে বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবন। কাজ করেছেন যৌনপল্লীর শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে। দেশজুড়ে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থান নির্মাণ করেছেন।

পুলিশের চাকরির পাশাপাশি লেখালেখি-গবেষণায়ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ ‘স্পিচেস অব শেখ হাসিনা’, ‘শেখ মুজিবের চিঠি’ ও একই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ ‘লেটারস অব শেখ মুজিবুর রহমান’, ‘নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’, ‘পিতা তুমি বাংলাদেশ’, ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’- এসব বইয়ে প্রথমবারের মতো বিস্তারিত উঠে আসে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা। এ ছাড়া হাবিবুর রহমানের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ঠার’ পাঠক সমাজে আলোচিত। এই বইয়ে তিনি বেদে সম্প্রদায়ের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। গ্রন্থটির জন্য হাবিবুর রহমান ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক-২০২৩’ লাভ করেন।

হাবিবুর রহমানের হাত ধরে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’ এ টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়। যেখানে বিনামূল্যে ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়া হয়।

তাঁর আরেকটি মানবিক উদ্যোগ ‘পুলিশ ব্লাড ব্যাংক’, যা করোনা রোগীদের প্লাজমা এবং ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট সরবরাহ করে কোডিড-১৯ ও ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের মাসিক প্রকাশনা ‘দ্য ডিটেকটিভ’ সম্পাদনা করছেন। সংস্কৃতিমনা হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ পুলিশ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর গবেষণা ও দিকনির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয়েছে জনপ্রিয় ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ ও ‘অচলায়তনের অপ্সরী’ নাটক ।

হাবিবুর রহমান একজন সফল ক্রীড়া সংগঠক। তিনি বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সেক্রেটারি এবং এশিয়ান কাবাডি ফেডারেশনের সহসভাপতি। বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি হাবিবুর রহমানের হাত ধরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নতুন উচ্চতায় আবির্ভূত হয়। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে দেশে বাংলাদেশ গেমস, যুব গেমস, জাতীয় কাবাডি প্রতিযোগিতা, আইজিপি কাপ জাতীয় যুব কাবাডি, প্রিমিয়ার কাবাডি লিগ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগ কাবাডি লিগসহ অসংখ্য কাবাডি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বকাপ কাবাডিতে বাংলাদেশ কাবাডির অবস্থান পঞ্চম। এ ছাড়া এশিয়ান কাবাডিতে পঞ্চম ও সাউথ এশিয়ান কাবাডিতে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। কাবাডিতে তাঁর অভূতপূর্ব উদ্যোগের কারণে ২০২২ সালে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর মধ্যে কাবাডি ফেডারেশন শ্রেষ্ঠ ফেডারেশন হিসেবে স্বীকৃতি পায়।