চট্টগ্রামের দামপাড়ায় মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) লাইন্সে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর উদ্বোধন করেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

চট্টগ্রামের দামপাড়ায় মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) লাইনসে পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর উদ্বোধন করেছেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

প্রায় ছয় হাজার বর্গফুট আয়তনের এই জাদুঘরে সংগ্রহ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত অস্ত্র, পোশাক ও অন্য জিনিসপত্র। জাদুঘরের একটি অংশজুড়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার। সেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের চট্টগ্রামের অংশটির পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন স্মারক/ডকুমেন্ট স্থান পেয়েছে।

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে “দিগ্বিজয়ী” প্রথম উইলিয়ামের নেতৃত্বে সহস্রাধিক নর্ম্যান, ব্রেটন, ফ্লেমিশ এবং অন্যান্য ফরাসি প্রদেশের অধিবাসীদের এক যৌথ বাহিনীর ইংল্যান্ড আক্রমণ, বিজয় ও অধিকারের ফলে অ্যাংলো-স্যাক্সন জনগোষ্ঠীর ইকোলজিতে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, তার কিয়দংশের সুরাহা করার জন্য ১২৩৩ ও ১২৫২ সালে জারি করা অধ্যাদেশে ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড বা কনস্টেবুলারি নিয়োগের আবশ্যকতা লিপিবদ্ধ ছিল। শান্তি স্থাপন ও রক্ষা এবং আইন প্রয়োগকে কাঠামো প্রদান করা হয়েছিল ১২৮৫ সালের ওয়েস্টমিনস্টার স্ট্যাটিউটের মাধ্যমে। অভিন্ন কায়দায় গোপনীয়তার সংস্কৃতিচর্চার ফলে পরবর্তী ৫০০ বছর পুলিশের ইতিহাসের অরৈখিকতা নিয়ে কোনো স্মারক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়নি বিধায় ১৮২৯ সালে রবার্ট পিল কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক মেট্রোপলিটন পুলিশকে তদানীন্তন নগর ও নাগরিকের আস্থা অর্জনে বহুমুখী নতুনত্ব আনতে হয়েছিল। বিজ্ঞানসম্মত, প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাজীবী ইতিহাসচর্চা ও গবেষণায় জানা যায় যে, রবার্ট পিলের নগর পুলিশ ও নাগরিকের মধ্যকার পারস্পরিক দূরত্ব ও পলায়নপরতা মূলত পুলিশের দেশ ও সমাজসম্পৃক্তার ইতিহাস স্মারক ও প্রমাণকের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে না পারার কারণেই। বর্তমান প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মকে স্বাধীনতা, সমাজ, পুলিশ সম্পর্কে যে প্রসঙ্গকাঠামো প্রদান করবে, তার আলোকেই ভবিষ্যতের নাগরিকেরা পুলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন।

জাদুঘর ঘুরে দেখেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

এই ইতিহাস সংবেদনশীলতা থেকেই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ আধুনিক শিল্প ও স্থাপত্যের মিশেলে নির্মিত জাদুঘরে নজিরবিহীন বিপ্লব ও দেশপ্রেমের স্মারক থরে থরে সাজিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের ব্রিটিশ পুলিশের চট্টগ্রামে অবস্থিত অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসের ধ্বংস সাধন ও ইউরোপিয়ান ক্লাবে হামলা চালানোর মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়াস এবং ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে চট্টগ্রামের এসপি এম শামসুল হক, কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল খালেক, দামপাড়া পুলিশ লাইনসের আরআই আকরাম হোসেনসহ ৮১ জন পুলিশ সদস্যের শাহাদাৎ বরণ এবং ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ অন্য ঘটনাবলিকে দৃষ্টিলব্ধ অবয়ব প্রদানের লক্ষ্যে মৌলিক ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে প্রতিষ্ঠিত লাল ভবনদ্বয়ের অখণ্ডতা বজায় রেখে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, শিল্প ও স্থাপত্যের ক্রিয়ামূলকতা ও মিনিমালিজম আরোপণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ দামপাড়া পুলিশ লাইনসে ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চট্টগ্রাম’ নির্মাণ করে।

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে যথাযথভাবে উপস্থাপন। মাস্টারদা সূর্য সেনের ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ ও মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে চট্টগ্রাম পুলিশের আত্মত্যাগ মূলত চট্টগ্রামের ইতিহাস। এর বিশেষ লক্ষ্য এ অঞ্চলে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার ইতিহাস বিষয়ে সচেতন করে তোলা, যার ফলে তারা মাতৃভূমির জন্য গর্ব ও দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হবে এবং উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর পিপিএম। উদ্বোধন শেষে আমন্ত্রিত অতিথিরা জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন সময়ের পুলিশের পোশাক, তৎকালীন সময়ের সরকারি দপ্তরের চিঠি, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, বীরশ্রেষ্ঠদের বৃত্তান্ত , বর্তমান পুলিশ সদস্যদের পোশাক, দামপাড়া পুলিশ লাইনসের ম্যাপ, ফাঁসির মঞ্চ, ভিজুয়াল ডিসপ্লে-সংবলিত হলরুম, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের ছবি, তথ্য, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকার নিউজ, বঙ্গবন্ধু কর্নার, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন বই, বঙ্গবন্ধুর ছবি ও তাঁর লেখা বই, মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র ইত্যাদি পরিদর্শন করেন।

এ সময় সেখানে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন বিপিএম (বার) পিপিএম (বার), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) মো. শামসুল আলম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) সানা শামিনুর রহমান, উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) মো. আমির জাফর বিপিএম, পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক পিপিএমসহ পুলিশের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু কর্নারে অতিথিরা। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

জাদুঘরটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে খুব শিগগির। পরিদর্শনের সময়সূচি ও প্রবেশমূল্য পরবর্তী সময়ে জানানো হবে। জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেজার শোর সময়সূচিও জানানো হবে দ্রুততম সময়ে।