ব্রহ্মাণ্ডের আদিমতম তারা তৈরির কারখানা। ছবি: নাসার সৌজন্যে।

কয়েক শ কোটি বছর আগের ফেলে আসা, হারিয়ে ফেলা দিনগুলোকে ফিরিয়ে দিল ১০৯ বছর আগে আঁকা একটি ‘ছবি’!

দিনগুলো এই ব্রহ্মাণ্ডের। ৯৪০ কোটি বছর আগের। আর ছবিটা প্রথম এঁকেছিলেন আইনস্টাইন। ১০৯ বছর আগে।

আইনস্টাইনের আঁকা সেই ছবিই খুঁজে বার করে দিল সেই ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’র যাবতীয় আলো, ঔজ্জ্বল্য। হ্যাঁ, আতশি কাচের মতো সেই আলো আর ঔজ্জ্বল্য আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়ে। এভাবেই নাগালের বাইরে চলে যাওয়া দিনগুলোকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে এনে দিল সেই ছবি। দেখা গেল, আদিমতম গ্যালাক্সির ‘আইনস্টাইন রিং (বলয়)’। খবর আনন্দবাজার পত্রিকার।

দেখা গেল, মহা-বিস্ফোরণ (‘বিগ ব্যাং’)-এর পর সৃষ্টির ঊষালগ্নে ব্রহ্মাণ্ডে প্রথম আলো ফোটার পর ঠিক কীভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে তারাদের জন্ম হচ্ছিল একটি আদিমতম গ্যালাক্সিতে। ব্রহ্মাণ্ডের নানা দিকে ৯৪০ কোটি বছরের পথ পেরোনোর পর সেই আলো, সেই ফেলে আসা দিনগুলো ধরা দিল মহাকাশে থাকা নাসার হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপে।

সেটা সম্ভবই হতো না যদি না আমাদের হাতে থাকত ১০৯ বছর আগে আইনস্টাইনের এঁকে দেওয়া একটি ছবি। যা প্রথম জানিয়েছিল, ব্রহ্মাণ্ডের আদিমতম দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনার উপায়।

কিস্তিমাত হলো এক আগন্তুকের দৌলতে!

অন্যতম গবেষক নিউ জার্সি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সৌরভ ঝা ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে জানিয়েছেন, আইনস্টাইনের আঁকা ছবির দেখানো পথেই কিস্তিমাত হলো। হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপ আর সেই আদিমতম গ্যালাক্সির মাঝে আচমকা এক আগন্তুক এসে পড়ায়। সেই আগন্তুকের সুবাদেই হাব্‌ল টেলিস্কোপ প্রথম দেখতে পেল ব্রহ্মাণ্ডের আদিমতম গ্যালাক্সির হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। মাঝখানে এসে পড়া সেই আগন্তুক শুধুই তার পেছনে থাকা আদিমতম গ্যালাক্সিটিকে হাব্‌লের নজরে এনে দিল তা-ই নয়; মুছে যাওয়া দিনগুলোর ঔজ্জ্বল্যকে প্রায় ২০ গুণ বাড়িয়েও দিল। হাবলের চোখে ধরা পড়ল ব্রহ্মাণ্ডের আদিমতম তারা তৈরির কারখানা। এই প্রথম।

মুছে যাওয়া দিনগুলির ঔজ্জ্বল্য বাড়ে কীভাবে ৯৪০ কোটি বছর পর?

পুরোনো বই, খাতায় ধুলো জমে। সেগুলো দিনে দিনে বিবর্ণ হয়। পাতার সাদা রং ধীরে ধীরে হলদেটে, পরে হলুদ রঙেরও হয়ে যায় পুরোপুরি সময়ের বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে। এভাবেই হারিয়ে যায় বিবর্ণ হয় মুছে যাওয়া দিনগুলি।

তাহলে প্রায় ১৪০০ কোটি বছর বয়সী ব্রহ্মাণ্ডের ফেলে আসা দিনগুলোর তো কয়েক শ কোটি বছর পর এতটাই বিবর্ণ হয়ে পড়ার কথা, যা কখনোই আর আমাদের নজরে ধরা দিতে পারবে না।

এ ক্ষেত্রে সেটা হলো কীভাবে? শুধুই যে মুছে যাওয়া দিনগুলি নজরে এল, তা-ই নয়; ৯৪০ কোটি বছর আগে তার যা ঔজ্জ্বল্য ছিল, কোটি কোটি বছর পর তা ২০ গুণ বাড়ানো সম্ভব হলোই-বা কীভাবে?

কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-র অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, এমনটা যে সম্ভব হতে পারে, ১৯১২ সালে আইনস্টাইন তাঁর একটা ছবি এঁকেছিলেন তাত্ত্বিকভাবে। পরে যা অন্তর্ভুক্ত হয় তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে।

সেই ছবি জানিয়েছিল, ব্রহ্মাণ্ডের মুছে যাওয়া আদিমতম দিনগুলোর আলো আমাদের নজরে নিয়ে আসা সম্ভব। কারণ, সেই আলো কোটি কোটি বছর ধরে ব্রহ্মাণ্ডের নানা দিকে দৌড়াচ্ছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ড আরও বেশি করে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। ফলে আদিমতম আলোর উৎস স্বাভাবিকভাবেই উত্তরোত্তর আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই মুছে যাওয়া দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই ব্রহ্মাণ্ডের স্থান ও কাল (‘স্পেস টাইম’) সোজা-সরল নয়। তা অত্যন্ত বক্র (‘কার্ভড’)। তাই তার ভেতর দিয়ে আলোর কণা ফোটনও চলে আঁকাবাঁকা পথে।

সেই বক্র স্থান ও কালে আরও একটি মহাজাগতিক বস্তু এসে পড়লে, তা আরও বক্র হয়ে পড়ে। সেই মহাজাগতিক বস্তুরও জোরালো অভিকর্ষ বল রয়েছে বলে। তখন আলোর কণার পথ আরও বেঁকে-চুরে যায়। সে ক্ষেত্রে মাঝখানে এসে পড়া কোনো মহাজাগতিক বস্তু তার পেছনে থাকা উৎস থেকে বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়া আলোকে একটি বিন্দুতে এসে জড়ো করে। নিজের অভিকর্ষ বলের টানে। আতশি কাচের মতো। তাতে সেই আলোকবিন্দুর ঔজ্জ্বল্য অনেক গুণ বেড়ে যায়। এই খানেই আইনস্টাইনের আঁকা ছবির মাহাত্ম্য। এই ঘটনাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং’।

এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে?

সন্দীপ বলছেন, “এ ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। যে আদিমতম গ্যালাক্সিতে ঝাঁকে ঝাঁকে তারার জন্মানোর আলো দেখতে পেয়েছে হাব্‌ল টেলিস্কোপ সেটি রয়েছে পৃথিবী থেকে ৯৪০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে (আলোর গতিবেগে ছুটলে এক বছরে যতটা দূরত্ব পাড়ি দেওয়া যায়)। গ্যালাক্সির নাম- ‘GAL-CLUS-022058s’। এর অর্থ- হাবলের নজরে আসতে সেই গ্যালাক্সির আলোর সময় লেগেছে ৯৪০ কোটি বছর। ফলে, হাব্‌ল সেই গ্যালাক্সির মুছে যাওয়া ৯৪০ কোটি বছর আগেকার দিনগুলোকে দেখতে পেয়েছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে মাঝখানে আরও একটি গ্যালাক্সি এসে পড়ায়। যা হাবলের নজর থেকে আদিমতম গ্যালাক্সিকে আড়াল করেনি; বরং তার আলোর ঔজ্জ্বল্যকে ২০ গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আতশি কাচের মতো।”

গ্যালাক্সি ও তারা: কার জন্ম হয়েছিল আগে

এখানেই শেষ নয়। এই আবিষ্কারের আরও গুরুত্ব রয়েছে। তা আগামী দিনে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার নতুন নতুন পথ খুলে দেবে, এমনটাই মনে করছেন সন্দীপ। তাঁর কথায়, “এই গ্যালাক্সি যে সময়ের তাতে বলাই যায় প্রথম প্রজন্মের তারা বা নক্ষত্র তৈরি হয়েছিল সেই সময়। আমাদের সূর্য দ্বিতীয় প্রজন্মের। তাই কীভাবে প্রথম প্রজন্মের তারারা তৈরি হয়েছিল আর তাদের থেকে কীভাবেই বা তৈরি হয়েছিল আমাদের সূর্যের মতো দ্বিতীয় প্রজন্মের তারারা, তা বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করবে এই আবিষ্কার। গ্যালাক্সি আগে নাকি তারাদের জন্ম হয়েছিল আগে সেই রহস্যেরও জট খুলতে পারে এই আবিষ্কার। এখানে দেখা যাচ্ছে, ৯৪০ কোটি বছর আগে গ্যালাক্সি তৈরি হওয়ার পর তারাদের জন্ম হয়েছিল।”

মুছে যাওয়া দিনগুলিকে আবার ফিরে পাওয়ার এই আবিষ্কার ব্রহ্মাণ্ডের বিকাশ-রহস্যের জটও এবার খুলে দিতে চলেছে বলে মনে করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।