নির্বাচনী উত্তাপ শেষ হয়েছে, কিন্তু নাশকতার ভয়াবহ চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠলে গণপরিবহনে চলাচলকারী যাত্রীদের মনে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদলীয় নেতাদের টানা হরতাল-অবরোধের কারণে দেশের গণপরিবহন সেক্টর চরম ঝুঁকি ও লোকসানের মুখে পড়ে। এতে করে দিন দিন গণপরিবহনে যাত্রীদের চলাচলে অনিরাপদ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দেশের সড়কপথ, রেলপথ, এই দুই সেক্টরে ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব সেক্টরে দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছে শিশু থেকে বৃদ্ধরা। এসব নাশকতার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল রেলপথ।

রেলের দুটি ঘটনা কাঁদিয়েছে সারা দেশের মানুষকে। তার মধ্যে ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনের ঘটনা ছিল ভয়াবহ। ট্রেনের একটি বগি থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ওই দিন সকাল ৭টার দিকে চারজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যায় রেলওয়ে থানা-পুলিশ।

তার কিছুদিন পরে ৬ জানুয়ারি রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের আগুনে দুই নারী, এক শিশুসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। আগুনে বেনাপোল এক্সপ্রেসের তিনটি কোচ পুড়ে যায়। সদ্য বিদায়ী বছরের ২৮ অক্টোবরের পর ট্রেনে আগুন ও নাশকতার ঘটনায় মোট নয়জনের মৃত্যু হয়েছে।

রেলপথে দুর্বৃত্তদের অগ্নিসংযোগে অস্থিতিশীল ও চরম বেকায়দায় পড়তে হয়েছে ট্রেনের যাত্রীদের। কেননা রেলপথকে কেন্দ্র করে নাশকতাকারীদের হামলার টার্গেট ছিল প্রবল। এ জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথ ও ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, পেট্রলবোমা ছোড়া, রেলপথের লাইন কেটে ফেলা, ক্লিপ খুলে নাশকতার দুর্ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত ৭৭ কিলোমিটার রেলপথ ও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৭৪ কিলোমিটার রেলপথ ছিল নাশকতাকারীদের অন্যতম টার্গেট। বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত রেলপথ এলাকা হিসেবে পরিচিত সীতাকুণ্ড, ফৌজদারহাট এলাকা। এই এলাকাগুলো নিয়ে সবচেয়ে আতঙ্কে ছিল রেলওয়ে পুলিশ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের রেলপথ, সিজিপিওয়াই, দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ণ রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)-এ আমদানি করা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্ট ব্লেন্ডার্স লিমিটেডসহ পেট্রোলিয়ামজাত দ্রবাদি সমগ্র বাংলাদেশে সরবরাহ হয় চট্টগ্রামের রেলপথ ধরে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও ফটিকছড়ির সাধারণ মানুষের নির্বিঘ্ন যাতায়াতের মাধ্যম হচ্ছে রেলপথ। সব মিলিয়ে সারা দেশে বিএনপি ও সমমনা দলের হরতাল অবরোধে নাশকতার চিত্র চোখে পড়লেও ব্যতিক্রম ছিল চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানা এলাকা।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার অধীনে থাকা প্রায় ৩৭৬ কিলোমিটার রেলপথে দুর্বৃত্তরা ট্রেন ও রেলপথে কোন ধরনের নাশকতার ঘটাতে পারেনি। চট্টগ্রামের রেলপথ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও রেলওয়ে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরীর বিচক্ষণতায় ও দায়িত্বশীল আচরণের ৭ জন উপ-পুলিশ পরিদর্শক, ৫ জন সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক ও ৪৬ জন পুলিশ সদস্য নিয়ে চট্টগ্রামের রেলপথকে নিরাপত্তা দিয়েছেন অফিসার ইনচার্জ এস এম শহিদুল ইসলাম। ফলে ছোট ও বড় ধরনের নাশকতার ছক কষলেও ব্যর্থ হয়েছে দুর্বৃত্তরা।

উল্লেখ্য, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও বর্তমান সরকার শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর শাপলা চত্বরে পুলিশি বাধায় সভার আয়োজন পন্ড হয়ে যাওয়ায় সারা দেশে হরতাল অবরোধের ডাক দিয়েছিল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। আর চলমান এসব সহিংসতায় রেলপথ নাশকতাকারীদের প্রধান হাতিয়ার ছিল। তাদের মুহুর্মুহু হামলায় নাজেহাল হয়ে পড়ে রেল কর্তৃপক্ষ। দেশের রেলপথে নিরাপদ যাত্রার পরিবর্তে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করত যাত্রীরা। এ কঠিন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানা কর্মদক্ষতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। দেশের রেলপথ, ট্রেন ও যাত্রীদের নিরাপত্তার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে সর্বদা সজাগ ছিলেন রেল পুলিশ। সূত্র: প্যাসেঞ্জার ভয়েস ডট নেট।