জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার চলমান কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাতের পটভূমিতে বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। খবর বাসসের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৯ জুন (বুধবার) জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে এ কথা বলেন। তিনি এ সময় কৃচ্ছ্রসাধন এবং সঞ্চয়ে মনোযোগী হওয়ার জন্য সবার প্রতি আহবান জানান।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চলমান করোনা অতিমারির অভিঘাত এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃংখল ব্যাহত হওয়ায় আমদানিভিত্তিক মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির যে ঊর্ধ্বগতি, তা নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপর প্রাধান্য দিয়েই এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘অতিমারি আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট ক্ষতি সাধন করেছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এই অতিমারির ক্ষতি সামলে সমৃদ্ধ উন্নয়নের পথে ফিরে আসার। আর সে ক্ষেত্রেও আমরা সাফল্য অর্জন করে বড় একটি বাজেটও দিতে পেরেছি। আমরা ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার একটি বাজেট উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি, যা অনেক দেশই পারেনি। কাজেই আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ সরকারের এটি বিরাট সাফল্য।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, শত বাধা ও চাপের মুখে পড়লেও আমরা দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছি। অনেক প্রতিকূল অবস্থায় আমাদের এগোতে হচ্ছে। যেখানে উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতা কামনা করি। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেই আমরা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করছি। তার মূলেই রয়েছে এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের একটা আলাদা শক্তি রয়েছে। শুধু যদি একবার তারা অনুধাবন করতে পারে, তাহলেই সেই শক্তিটা বোঝা যায়, যেটা পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার ডাকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে একদা এ দেশের মানুষই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। তারা জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল। আর সেই মানুষের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কাজেই সেই মানুষকে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই আমরা এগিয়ে যাব ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে, আমি মনে করি জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতায় আমরা তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারব, ইনশাল্লাহ।

কৃচ্ছ্রসাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে প্রত্যেককেই নিজ নিজ জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে, সঞ্চয় করতে হবে। প্রত্যেকের নিজস্ব সঞ্চয় বাড়ানোর পাশাপাশি সকলকে মিতব্যয়ী হতে হবে। বিলাস দ্রব্য পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাতেই মনোযোগী হতে হবে। তাঁর সরকার আজকে ঘরে ঘরে যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে, সেটি ব্যবহারে এবং পানিসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধাগুলো ব্যবহারেও তিনি সকলকে মিতব্যয়ী হবার আহবান জানান।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তাঁর সরকারকে সার, বিদ্যুৎ, তেল ও গ্যাসের ক্ষেত্রে বর্ধিত ভর্তুকি প্রদান করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে আগামী অর্থবছরে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, সার ও বিদ্যুৎ খাতে যে ঘাটতি হবে, তা আমরা মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তা সাধারণের ওপর শতভাগ চাপিয়ে দেব না। ফলে আগামী অর্থবছরে ভতুর্কির ব্যয় বাড়বে। সে কারণে কার্যকর ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভর্তুতিকে সহনশীল পর্যায়ে রাখা এবং আমদানির ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেব।

তাঁর সরকার মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতি যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, তার ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য টাকার মূল্যমান পুনর্নির্ধারণ করা হচ্ছে। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ সময় সবাইকে দেশি পণ্য ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে বলেন, সবাইকে দেশি পণ্য ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে। তিনি এ প্রসঙ্গে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের উল্লেখ করে কথায় কথায় চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছুটে যাওয়াকেও নিরুৎসাহিত করেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ এর আরেকটি ঢেউ এসেছে। চতুর্থ ঢেউ। করোনাভাইরাস আমরা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছি। পাওয়ার যোগ্য সবাইকে টিকা দিয়েছি। জীবন-জীবিকার সুরক্ষা যতটুকু দেওয়ার, তার সবটুকুই আমরা দিতে সক্ষম হয়েছি। করোনা নতুনভাবে আবার দেখা দিয়েছে। সবাইকে বলব স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলতে। করোনা মোকাবিলায় আমরা যে সাফল্য এনেছি, সেটা ধরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার করোনা মোকাবিলার প্রণোদনা হিসেবে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ২৮টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকার সহায়তা প্রদান করেছে।

করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে উল্লেখ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতিমারি আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। তবে, আমরা এই ক্ষতি সামলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। সরকার কার্যকর ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেকোনো ধরনের বাধা আসুক না কেন, আমরা তা মোকাবিলা করতে পারব। সেই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে। করোনা অতিমারির সময়ে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে, তা চলমান থাকবে বলেও জানান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের রপ্তানি বেড়েছে। আমরা ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি করতে পেরেছি। অতিমারি মোকাবিলা করেও ৫০ বিলিয়নের ক্লাবে প্রবেশ করতে পেরেছি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাজেটে কৃষি খাতের বিকাশ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি, ছত্রাক ও বালাইনাশক উৎপাদন উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া পশুপাখি, মৎস্য খাতের চলমান বিকাশ অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নিবন্ধিত পোলট্রি, ডেইরি ও ফিশ ফিড সরবরাহের যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে মুসক অব্যাহতি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষি ও খাদ্যশিল্পে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতিতে রেয়াতি সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি এবং দ্রুততম সময়ে করদাতা সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে অটোমেটেড ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সব প্রস্তুতি গ্রহণ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং স্থানীয় শিল্পের বিকাশে ও বাণিজ্য সহজীকরণের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং রপ্তানিমুখী ও ভারী শিল্পের বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান এবং ‘মেড ইন বাংলাদেশ’স্লোগান অব্যাহত রাখাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক হার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্য খাতকে সুসংহতকরণে ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সাথে শ্রবণপ্রতিবন্ধী ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের ব্যবহার্য কতিপয় পণ্যের ওপর প্রযোজ্য শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, শিল্প খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে এবং রপ্তানি শিল্পের প্রসারের কৌশল হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, রপ্তানিমুখী শিল্প, ইস্পাতজাত শিল্প, মোটরসাইকেল উৎপাদন শিল্প, রাবার শিল্প, ইলেকট্রনিকস শিল্পের উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রধান ও তৈরি পণ্য আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশীয় কম্পিউটার বা ল্যাপটপ বা আইসিটি পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা সম্প্রসারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়, আমদানি নিরুৎসাহিতকরণ এবং বিলাস পণ্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিলাসবহুল মোটর গাড়ি ও জিপ এবং ঝাড়বাতি ও লাইট ফিটিংসের ওপর আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আরোপের মাধ্যমে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাংলাদেশ ক্ষতবিক্ষত উল্লেখ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়েই আমাদের চলতে হয়। দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতির পিতা দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখন বন্যা চলছে। দক্ষিণাঞ্চলে ভাদ্র মাসের দিকে আসে। এই বন্যাও আমরা মোকাবিলা করতে পারব। পদ্মা সেতু এই বন্যা মোকাবিলায় সহায়তা করবে।

সবার জন্য পেনশন বিমা চালুর বিষয় উল্লেখ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এ প্রক্রিয়ায় অনেক দূর এগিয়েছি। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে সর্বজনীন পেনশন চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকে এ আইনের অনুমোদন দিয়েছি। খুব শিগগির সংসদে আইনটি উঠবে। আমরা তা কার্যকর করতে পারব। তাতে যাঁরা পেনশন পাবেন, তাঁদের জীবনটা সুরক্ষিত হবে।