জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের সমালোচকরা আসলে দেশের জনগণের সামর্থ্য জানে না, বরং তারা জাতির সামর্থ্যকে সবসময় অবমূল্যায়ন করে। তিনি বলেন,‘আমাদের সমালোচনাকারিরা দেশের মানুষের শক্তি, সাহস ও ক্ষমতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। নইলে তারা বার বার বাধা দেবে কেন? তারা আসলে জাতি হিসেবে আমাদের সক্ষমতাকে সবসময় অবমূল্যায়ন করে। হেয় প্রতিপন্ন করে। সবসময় যেন অন্যের কাছে হাত পেতে চলার মানসিকতায় ভোগে।’ খবর বাসসের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ৩০ ‍জুন (বৃহস্পতিবার) জাতীয় সংসদের অষ্টাদশ ও ২০২২ সালের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এসব কথা বলেন। এ সময় মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন। এ দিন সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট পাস করা হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে এখানে কতগুলো প্রশ্ন এসেছে, বিরোধী দলের সদস্যরা অনেক কথাই বলেছেন। প্রথম প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ হাজার কোটি ধরা হলেও পরবর্তীতে ৩০ হাজার কোটি লাগার কার্যকরণ বিশ্লেষণ করেন তিনি। তিনি বলেন, এই সেতু নির্মাণে তাঁর সরকারের বহুদিনের প্রচেষ্টা ছিল, যার ভিত্তিপ্রস্তরও তিনি ২০০১ সালে স্থাপন করে যান। যদিও পরবর্তী বিএনপি সরকার সেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। আর ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি ব্যয় প্রাক্কলন করে (১০ হাজার কোটি টাকা) যার কোন বাস্তব ভিত্তি যেমন ছিলনা তেমনি এরপর বহু যোজন বিয়োজন হয় প্রকল্পে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্রচালনার দায়িত্ব পেয়ে আওয়ামী লীগ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় এবং সরকারের দায়িত্ব নেয়ার ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল এইকম’কে নিয়োগ দেয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় রেল সুবিধা যুক্ত করে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের নির্দেশ প্রধান করেন তিনি। শুরুতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক পাঁচ-আট কিলোমিটার। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক এক-পাঁচ কিলোমিটার হয়। প্রথম ডিপিপিতে সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে তিনটির নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা রেখে নকশা করা হয়েছিল। পরে ৩৭টি স্প্যানের নিচ দিয়ে নৌযান চলাচলের সুযোগ রাখার বিষয়টি যুক্ত করা হয়।
সংশোধিত ডিপিপিতে বেশি ভার বহনের ক্ষমতাসম্পন্ন রেল সংযোগ যুক্ত করা হয়। কংক্রিটের বদলে ইস্পাত বা স্টিলের অবকাঠামো যুক্ত হয়। সেতু নির্মাণে পাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও বাড়তি গভীরতা ধরা হয়। বাড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ব্যয়ও।

সেতু নির্মাণকালিন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সে সময়কার দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রতিশ্রুত অর্থ প্রত্যাহার করে নিলে অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও তখন সরে দাঁড়ায়। যদিও পরবর্তীতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার একটি আদালতে মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হয়। আর নিজস্ব অর্থেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

সে সময় দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, আমি জানি তখন আমাদের দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারি এমনকি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভেবেছিলেন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকা ছাড়া এই সেতু নির্মাণ সম্ভব হবেনা, যে কথাটি আমাকে বার বার শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নিজস্ব অর্থায়নে সেতু করতে পারলে তবেই করবো, কারো কাছে হাত পেতে করবো না এবং বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াবে ও নিজেই করবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সেতু নির্মাণ করতে গেলে দেশিয় রিজার্ভের ওপর চাপ আশার যে আশংকা ছিল সেখানে তাঁর একটা হিসেবে ছিল যে সেতুটি নির্মাণে প্রায় ৬ থেকে ৭ বছর সময় লাগতে পারে এবং সে সময়ে বছরে ৫০ মিলিয়ন ডলার করে যদি ব্যয় করা যায় তাহলে রিজার্ভে কোন চাপ পড়বে না।

নিজস্ব অর্থায়ণে তাঁর সেতু নির্মাণের ঘোষণায় দেশের জনগণের স্বতস্ফ’র্ত ভাবে সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসার কথাও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, কানাডার কোর্ট যখন বলে দিল পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি তখন মানুষের মাঝে একটা অন্যরকম চেতনা আসলো। আর সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। আর এক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে যাওয়ার কোন পথ ছিলনা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মাসেতু কেবল দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশ যাতে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে তার স্বর্ণদুয়ারও উন্মোচন করেছে। তিনি বলেন, অনেক জুজুর ভয়, অনেক কিছুই দেখানো হয়েছে, খোঁজার চেষ্টা করেছেন এধরণের বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতাটা আসলে কিসে। সেটা হচ্ছে এডমিনিষ্ট্রেশন, ম্যানেজমেন্ট এবং গুডগভার্নেন্স। আর এই তিনটা শক্তি আমাদের আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন বলেও মাননীয় প্রধামন্ত্রী জানান। অনেক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিয়ে তাঁর সরকার প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণের পদক্ষেপ প্রহণ করেছে।

এ ক্ষেত্রে দেশবরেণ্য একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেলের তত্ত্বাবধানে এবং দেশ-বিদেশের সেরা বিশেষজ্ঞদের মনিটরিং এর মাধ্যমে সমগ্র টেন্ডার প্রক্রিয়া, কনসালটেন্ট নিয়োগ, নির্মাণ কাজ সব কিছুই যাতে আন্তজাতিক মান সম্পন্ন হয় তা নিশ্চিতেরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সেক্ষেত্রে নদীর বৈচিত্রতার কারণে নির্মাণকালিন ২০১৩ সালে একটি ভ’মিধ্বস হলে রেলের লাইন স্থাপনের অনেক সামগ্রী তলিয়ে যায় এবং নদী শাসনের এলাকা ১ দশমিক ৩ কি.মি. বৃদ্ধি করা হয় বলে তিনি জানান।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মূল সেতু নির্মাণ ও নদী শাসনের লক্ষ্য নিয়ে ঠিকাদার টেন্ডার দাখিলের সময় যে ব্যয় উল্লেখ করেছিল সেতু সমাপ্ত হবার পরও মূল সেতু নির্মান ও নদী শাসনের ক্ষেত্রে তার অতিক্রম হয়নি। তিনি এ সময় সানফ্রান্সিসকে তে ‘ওকল্যান্ড বে ব্রীজ’, হংকং এ ‘ম্যাকাও ব্রীজ’ নির্মাণের সময়কার প্রাক্কলন ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে পদ্মাসেতুর নির্মাণ ব্যয় অত্যন্ত সাশ্রয়ী হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। যেখানে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২,১৩৩.৩৯ কোটি টাকা(৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার ও গ্যাস লাইনের ব্যয় বাবদ ১,০০০ কোটি টাকা সহ)। আর পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এই সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেকোন বিচারে এই ব্যয় (পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়) অত্যন্ত সাশ্রয়ী। সমসাময়িক সময়ে নির্মিত সব সেতুর সাথে এই সেতুর নির্মাণ ব্যয় অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ন। নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ দেশ ও জাতির বড় পাওনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, এতে করে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে সমগ্র জাতির উপর। সবাই এখন দৃঢতার সাথে বলতে পারছে যে আমরাও পারি, বাংলাদেশ পারে।

শেখ হাসিনা বলেন, এর মাধ্যমে মানুষের ভেতরের যে শক্তি উৎসারিত হয়েছে সেই শক্তিই আমাদের নিয়ে যাবে ২০৪১ সালের উন্নত- সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথে। মানুষের এই শক্তিই আমাদের পথ দেখাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বাজেট অধিবেশনে অনেক প্রানবন্ত আলোচনা হয়েছে। ২২৮ জন সংসদ সদস্য ৩৮ ঘন্টা ৫৭ মিনিট আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। যেখানে বিরোধী দলসহ বিভিন্ন নেতারা যথেষ্ট আলোচনার সুযোগ পেয়েছেন এবং ইচ্ছেমত তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও সমাপনী ভাষণ দেয়ায় তিনি বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকেও শুভেচ্ছা এবং ধন্যবাদ জানান।