সি-উইড সাগর বা নদীর তলদেশে জন্মায়। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সরকার সম্প্রতি জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের একান্ত সমুদ্র এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির বেশ কিছু মূল্যবান উদ্ভিদজাত এবং প্রাণিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রায় দু বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে ২২০ প্রজাতির সি-উইড চিহ্নিত করা হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে।

কর্মকর্তারা বলেছেন, যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলে সি-উইড বাংলাদেশের জন্য ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। খবর বিবিসির

কক্সবাজার উপকূলে পরীক্ষামূলক চাষের সি-উইডের একটি প্রজাতি। ছবি: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট

সি-উইড আসলে কী?
সি-উইড – যার আক্ষরিক অর্থ ‘সামুদ্রিক আগাছা’ – একধরনের শৈবাল।

এটি একধরনের সালোক-সংশ্লেষণকারী ফুলবিহীন উদ্ভিদ এবং সাধারণত সাগর বা নদীর তলদেশে জন্মায়।

এর কোনো শিকড়, ডালপালা ও পাতা থাকে না।

এটি সাধারণত উপকূলীয় সামুদ্রিক এলাকার পাথর, বালি, কাদা, খোলস বা অন্যান্য শক্ত অবকাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।

মূলত তিন ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল দেখা যায়; লাল, বাদামি এবং সবুজ।

কী কাজে লাগে
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, সি-উইড বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। পুষ্টিগুণের বিচারে বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে এটি।

তিন ধরনের সি-উইডের মধ্যে সবুজটি সাধারণত খাবার হিসেবে খাওয়া হয়। আর লালটি হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। আর বাদামি সি-উইড খাবার ও হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন দুই কাজেই ব্যবহার হয়।

হাইড্রোকলয়েড উৎপাদন সাধারণত শিল্প উৎপাদনে জলীয় কাঁচামাল হিসেবে কাজে লাগে।
খাবার হিসেবে ছাড়াও ডেইরি, ওষুধ, টেক্সটাইল, কাগজ শিল্প এবং জেল জাতীয় খাবারে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় সি-উইড।

তবে খাবার হিসেবে জাপান, চীন এবং কোরিয়ায় খাবারে সি-উইড ব্যবহারের বহুল প্রচলন রয়েছে।

বাংলাদেশে এটির খাবার হিসেবে তেমন চাহিদা নেই, কিন্তু শৌখিন শহুরে খাবারে একটু একটু করে এর ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে।

সামুদ্রিক শৈবাল মানবদেহের প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করে।

তা ছাড়া জমিতে সার, প্রাণী খাদ্য ও লবণ উৎপাদনেও সি-উইড ব্যবহার করা যায়।

বাংলাদেশে সি-উইডের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গবেষণায় একান্ত সমুদ্র এলাকায় ২২০ প্রজাতির সি-উইড পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে ৫ ডিসেম্বর।

তবে বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি প্রতিষ্ঠান মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট ২০১৮ সাল থেকে সি-উইড নিয়ে গবেষণা করছে, এবং তারা বলছে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ধরে চার বছরের গবেষণায় এ পর্যন্ত ১৪৩ প্রজাতির সি-উইড চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে উপকূলে সি-উইড চাষ এবং সি-উইডজাত পণ্য উৎপাদন গবেষণা সরকারি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মহিদুল ইসলাম বলেছেন, এর মধ্যে ২৩ প্রজাতির সি-উইডকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে গবেষণায় দেখা গেছে। এই ২৩ প্রজাতির মধ্যে ১৮টি রপ্তানিযোগ্য ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক। আর আমরা ৬টি প্রজাতি চাষ করে সফল হয়েছি, যা স্থানীয় কৃষকেরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে পারবেন।’

মহিদুল ইসলাম আরও বলেছেন, একদিকে খাবার হিসেবে, আর সেই সাথে শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে সি-উইড রপ্তানির ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।

সরকারি উদ্যোগে বর্তমানে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ হচ্ছে এই সামুদ্রিক শৈবাল। দেশে বর্তমানে পাঁচ হাজার টন সামুদ্রিক শৈবাল উৎপাদিত হচ্ছে।

ইতিমধ্যে পটুয়াখালীতে একটি গবেষণা ল্যাবও বসানো হয়েছে।

জাহানারা ইসলামের স্যুপ, বিরিয়ানি, তেহারি

বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সি-উইড চাষ করেছিলেন কক্সবাজারের বাসিন্দা জাহানারা ইসলাম।

একসময় কৃষি বিভাগে কাজ করা মিজ ইসলাম ১৯৮৩ সালে শখের বশে সৈকত থেকে কুড়িয়ে এনে বাড়িতে পাথর আর বেলে মাটিতে বসিয়ে দিয়েছিলেন।

এর নাম আর কার্যকারিতা সম্পর্কে জেনেছিলেন তারও প্রায় এক দশক পরে, এক জাপানি গবেষক দলের কাছ থেকে।

কিন্তু নিজের আগ্রহে সি-উইড পরিচিতি, চাষ পদ্ধতি আর বিভিন্ন প্রজাতি সম্পর্কে নিরন্তর জানার চেষ্টা করছিলেন তিনি।

এখন তিনি সি-উইড ব্যবহার করে নানা রকম খাবার তৈরি করেন। তিনি বলেছেন, ‘সি-উইড ব্যবহার করে আমি ১২৮ রকমের খাবার তৈরি করেছি। সেগুলো দেশের ভেতরে বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়, উদ্যোক্তা ও সৃজনশীল মেলায় সেসব প্রদর্শিত হয় এবং বিক্রি হয়। এটাকে চুলায় জ্বাল দিয়ে নির্যাস বের করে নেওয়া যায়, তখন সেটা সিরকা বা সয়া সসের মতো একটা উপাদান হয়। যেকোনো খাবারে, সেটা পরিমাণ মানে ধরুন একজন মানুষের জন্য খাবার তৈরিতে এক চা-চামচ পরিমাণ দিলে খাবারের স্বাদ বদলে যায়। এটা দিলে অন্য মসলা কম লাগে।

মিজ ইসলাম এখনো দেশের মধ্যেই খাবার বিক্রি করলেও এ বছরই বিদেশে রপ্তানি শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন।