পিবিআইয়ের হেফাজতে গ্রেপ্তার এক আসামি।

পাঁচ বছর আগে সংঘটিত জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটন করেছে পিবিআই।

ভাতিজা হত্যার দায় চাচার ওপর চাপিয়ে চাচাকে প্রথমে পালিয়ে যাওয়া এবং চাচার লাশ পাওয়ার পর আত্মহত্যার অপবাদের নাটক মঞ্চস্থ করেন হত্যাকারীরা। ঘটনাটি ঘটে ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকার কদমতলী থানাধীন ‘কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেস’-এর মেসে।

ভিকটিম সোহেল মিয়া টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর থানার ঘুনিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। সোহেল প্রতিবেশী চাচা আসামি ইকবাল হোসেনসহ ঢাকার কদমতলী থানাধীনকথা এন্টারপ্রাইজ প্রেসে চাকরি করতেন। ওই এন্টারপ্রাইজের কর্মচারী মো. হাসান মিয়া ইকবালের স্ত্রী পারভীন বেগম (৪০) এর মোবাইলে ফোন সোহেলের পরিবারকে জানান, ৬ নভেম্বর রাত ৩টায় কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেসের মেসে ইকবাল তাঁর প্রতিবেশী ভাতিজা সোহেলকে লোহার রড দিয়ে মেরে আহত করে পালিয়ে গেছেন। প্রেসের মালিক ও কর্মচারীরা সোহেলকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পান্থপথ ইউনিহেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করান।

এ ঘটনায় সোহেলের ছোট ভাই মো. সাইদুর রহমান (২৮) ৭ নভেম্বর বাদী হয়ে ইকবালের (৫৫) বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় মামলা করেন।

কদমতলী থানা-পুলিশ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।

এরপর ইউনিহেলথ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ নভেম্বর সোহেল মারা গেলে ভিকটিম সোহেলের ছোট ভাই বাদী মো. সাইদুর রহমান (২৮) বিজ্ঞ আদালতে আবেদন করে তাঁর দায়ের করা মামলায় পেনাল কোড আইনের ৩০২ ধারা সংযোজন করেন।

তদন্তকালে থানা-পুলিশ সোহেল হত্যার মামলার বাদীর মাধ্যমে জানতে পারেন, মামলার এজাহারনামীয় পলাতক আসামি ভিকটিম ইকবাল নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের বরপা বিক্রমপুর স্টিল মিলের বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে গাছের সঙ্গে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। সোহেলের মৃত্যুর সংবাদ জানার পর মেসের অন্য কর্মচারীরা নতুন আইডিয়া উপস্থাপন করেন, ইকবাল আত্মহত্যা করেছেন। থানা-পুলিশ আসামি ইকবাল আত্মহত্যা করায় তাঁকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি চেয়ে ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি মামলাটিতে চূড়ান্ত রিপোর্ট বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করে এবং কোনো তদবির না থাকায় বিজ্ঞ আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা নথিভুক্ত করেন।

এদিকে রূপগঞ্জ থানা-পুলিশ সোহেলের চাচা ভিকটিম ইকবালের মোবাইল থেকে তাঁর পরিবারের লোকজনকে ফোন করে জানান, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন বরপায় গাছের সঙ্গে গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় ইকবালের লাশ পাওয়া গেছে। খবর পেয়ে ইকবালের স্ত্রী ও ভাতিজা রূপগঞ্জ থানায় গিয়ে ভিকটিম ইকবালের অর্ধগলিত লাশ শনাক্ত করেন। ইকবালের মৃত্যুসংক্রান্তে রূপগঞ্জ থানায় মামলা হয়। তবে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে হত্যা উল্লেখ থাকায় ভিকটিম ইকবালের স্ত্রী বাদী হয়ে প্রেসের ১০ জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানার মামলা দায়ের করলে রূপগঞ্জ থানা-পুলিশ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।

মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারনামীয় ১-৬ নং আসামিদের গ্রেপ্তার করেন। থানা-পুলিশ তদন্ত করাকালে পুলিশ সুপারের নির্দেশে সহকারী পুলিশ সুপার ‘গ’সার্কেল নারায়ণগঞ্জ মামলাটি তদন্ত করেন। তিনি আগে গ্রেপ্তার করা আসামি ছাড়াও প্রেসের আরও ২ জন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেন। তদন্ত চলাকালীন ২০১৮ সালের ২২ মে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ পরিদর্শক আক্তারুজ্জামান মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। তিনি পূর্বের গ্রেপ্তার এজাহারবহির্ভূত আসামি জাহানুর ও মো. জামালকে পুলিশ রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাঁরা কোনো তথ্য দেননি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মামলার বিষয়ে আলোচনায় তিনি দিকনির্দেশনা পান, আসামিরা কোনো গাড়ির সাহায্যে ইকবালের লাশটি রূপগঞ্জের বরপায় নিয়ে যেতে পারেন। তদন্তকারী দল ওই ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা ও গাড়ি চালানোর কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে এলাকায় কয়েকটি গাড়ির চলাচল সন্দেহ হওয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ধোলাইখাল থেকে একটি গাড়িসহ মো. নুর আলমকে (৩৫) আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, ২০১৭ সালে তিনি মো. বাদল মিয়ার পিকআপ চালাতেন। তিনি বাদলকে পিকআপসহ আসতে বললে বাদল তা নিয়ে আসেন। নূরু গাড়িটি এবং মালিক বাদলকে শনাক্ত করে। নূরু ও বাদলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তাঁরা লাশ গুম করার কথা স্বীকার করেন এবং প্রেসের কর্মচারীরা যে ইকবালকে হত্যা করেছেন, সেই তথ্য দেন। লাশ গুমের কাজে তাঁদেরকে সহযোগিতা করেছেন জামাল, মামুনসহ মোট ৭ জন। তাঁদের ২ জনকে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে তাঁরা স্বেচ্ছায় বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জবানবন্দি দেন। তাঁদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে ২টি জোড়া খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটিত হয়।

পিবিআই জানায়, প্রকৃত ঘটনা হলো ভিকটিম ইকবাল পরহেজগার ছিলেন এবং ভোরে নামাজ পড়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে রুমের লাইট জ্বালাতেন। রুমের লাইট জ্বালিয়ে রাখা নিয়ে অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁর প্রায়ই ঝগড়া হতো। ঘটনার দিন রাত ৩টায় প্রথমে এজাহারনামীয় আসামি আ. রহমানের সঙ্গে ইকবালের ঝগড়া, হাতাহাতি ও মারামারি হয়। অন্য কর্মচারীরাও মারধরে যুক্ত হন। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের ফলে তাঁরা সবাই মিলে ইকবালকে মারধর ও শ্বাসরোধে হত্যা করেন। তখন তাঁর প্রতিবেশী ভাতিজা সোহেল তাঁর চাচাকে রক্ষা করতে গেলে আসামিরা তাঁকেও লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে পিটিয়ে আহত করেন। এজাহারবহির্ভূত আসামি জামাল তাঁর পূর্বপরিচিত পিকআপ ড্রাইভার নূর আলম (৩৫) এবং গাড়ির মালিক বাদলের সঙ্গে কথা বলে ২০ হাজার টাকায় একটি পিকআপ ভাড়া করেন। পিকআপ মালিক বাদল এবং ড্রাইভার নূর আলম পিকআপটি প্রেসে নিয়ে আসেন। তাঁরা ইকবালের লাশ গাড়িতে উঠিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের বরপা বিক্রমপুর স্টিল মিলের বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন।