গ্রেপ্তার হওয়া ওয়াসিম ও হত্যাকাণ্ডের শিকার নাজমা বেগম। ছবি: টাঙ্গাইল জেলা পিবিআই

১৭ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানাধীন আজগানা ইউনিয়নের ঘাগড়া গ্রামের এসএবি নামের একটি ইটভাটার পশ্চিম পাশে কলাবাগানে অজ্ঞাতনামা এক নারীর অর্ধগলিত লাশ পড়ে থাকার খবর পেয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপারের (পিবিআই) নির্দেশে একটি চৌকস ক্রাইমসিন টিম দ্রুততার সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে এবং থানা-পুলিশকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে। পিবিআই টিম তাৎক্ষণিক লাশের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য লাশের ফিংগার প্রিন্ট নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে জানতে পারে, ওই নারীর নাম নাজমা বেগম (৩১)। পিতা- আবদুর রহমান, মা-অজুফা বেগম, গ্ৰাম দেবীর চর বেড়িবাঁধ থানা-লালমোহন, জেলা-ভোলা।

টাঙ্গাইল জেলা পিবিআই হত্যা মামলাটির ছায়া তদন্ত শুরু করে। নাজমার আত্মীয়স্বজন ও ইটভাটার শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে, মো. ওয়াসিম নামের এক ব্যক্তি নাজমার দ্বিতীয় স্বামী। ওয়াসিমের সঙ্গে দেখা করার জন্য নাজমা ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের এসএবি ইটভাটায় আসেন। ওই এসএবি ইটভাটার শ্রমিকদের সর্দ্দার মতিউর রহমান জানান, মো. ওয়াসিম হকের বাড়ি দিনাজপুরের খানসামায়। ওই ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। ১২ ডিসেম্বর থেকে তিনি ইটভাটায় অনুপস্থিত। অন্য শ্রমিকেরা জানান, ওয়াসিমের দ্বিতীয় স্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ইটভাটায় এসেছিলেন। লাশটি অর্ধগলিত থাকায় তাঁরা চিনতে পারেননি। পিবিআই তদন্ত টিম পলাতক ওয়াসিমকে গ্রেপ্তার করার জন্য ঢাকা, দিনাজপুরসহ সম্ভাব্য বেশ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালায়। একপর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওয়াসিমের অবস্থান শনাক্ত করে দিনাজপুরের খানসামা থানাধীন মুন্সিপাড়া এলাকা থেকে গতকাল মঙ্গলবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াসিম জানান, ২০১৯ সালে মোহাম্মদপুর থানাধীন ঢাকা উদ্যানের পাশে একটি ইটভাটায় কাজ করার সময় নাজমার সাথে তাঁর পরিচয় হয়। নাজমা বেগম ওই ইটভাটায় শ্রমিকদের বাবুর্চির কাজ করতেন। ওই ইটভাটায় ৪-৫ মাস কাজ করেন ওয়াসিম। এই সময়ে নাজমা বেগমের সাথে ওয়াসিমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০২০ সালে শুরুর দিকে দেশব্যাপী করোনা মহামারির জন্য ইটভাটার কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওয়াসিমসহ অন্যান্য শ্রমিক মিলে নিজ এলাকা দিনাজপুর চলে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেন। ওয়াসিমের দিনাজপুর চলে যাওয়ার সংবাদটি নাজমা বেগমকে মোবাইল ফোনে জানালে নাজমা ওয়াসিমকে বলেন, ‘দেশে তো চলে যাবা, আমার বাসায় আসিয়া একটু দেখা কইরা যাও।’ এরপর তাঁরা ঢাকা উদ্যানে দেখা করেন। নাজমা ওয়াসিমকে অনুরোধ করেন তাঁর ভাড়া বাসায় যাওয়ার জন্য। ওয়াসিম নাজমার বাসায় গিয়ে দেখতে পান, ওই বাসায় দুজন নারী ও একজন বয়স্ক পুরুষ লোক অবস্থান করছেন। পরে নাজমার ব্যাপক চাপাচাপিতে তিন লাখ টাকা দেনমোহরে তাঁদের বিয়ে হয়। ওই দিনই ওয়াসিম অন্য শ্রমিকদের সাথে দিনাজপুরে চলে যান। ওয়াসিম দিনাজপুর গিয়ে নাজমার সাথে কিছুদিন গোপনে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন। পরে নাজমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। প্রায় ১ মাস আগে টাঙ্গাইল জেলার এসএবি ইটভাটায় লেবার সর্দার মতিউর রহমানের সাথে কাজ করতে যান। ইটভাটাতেই রাত্রি যাপন করতেন ওয়াসিম। ইটভাটায় কাজ করতে আসার দুই দিন পর নাজমা বেগম জানতে পারেন, ওয়াসিম মির্জাপুরে ইটভাটায় কাজে যোগদান করেছেন। ওয়াসিম তাঁর কাজে যোগদান করার বিষয়টি নাজমাকে মোবাইল ফোনে জানান। নাজমা ওয়াসিমকে ঢাকার বাসায় আসতে বলেন।

ওয়াসিম নাজমার সাথে যোগাযোগ করে বছিলা এলাকায় নাজমার ভাড়া করা বাসায় যান। নাজমার ভাড়া বাসায় ওয়াসিম যাওয়ার পর ওয়াসিমের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি নাজমা বেগম নিয়ে ওয়াসিমের আত্মীয়স্বজনের কাছে ফোন দিয়ে তাঁদের বিয়ের সংবাদটি জানান। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়। একপর্যায়ে ওয়াসিম মোবাইল ফোনটি রেখে বাসা থেকে বের হয়ে মির্জাপুরের ইটভাটায় চলে আসেন। ওয়াসিম চলে আসার দুই দিন পর নাজমা ও তাঁর ভাই পরিচয়দানকারী একজনকে সাথে নিয়ে ওয়াসিমের মোবাইল ফোনসহ মির্জাপুর ইটভাটায় যান। নাজমা ওয়াসিমের সাথে ইটভাটায় থাকতে চান। ওয়াসিম জানান, ভাটার ভেতরে ‘বউ নিয়া থাকার সুযোগ নাই’। নাজমা এবং ওয়াসিমের মধ্যে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। তখন ওয়াসিম নাজমাকে বুঝিয়ে চলে যেতে বলেন এবং এক সপ্তাহ পরে এলে তাঁকে নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকবেন বলে জানান। এরপর ১১ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক আটটার দিকে নাজমা ওই ইটভাটায় যান। ওয়াসিম নাজমাকে নিয়ে তাঁদের মেসের নারী বাবুর্চির বাসায় যান। ওয়াসিম ও নাজমা কিছু সময় সেখানে অবস্থান করেন। বাবুর্চি তাঁদের রাতে সেখানে থাকতে বলেন এবং পরের দিন তাঁদের বাসা ভাড়া করে দেবেন বলে জানান। একথা শুনে নাজমা রাগান্বিত হয়ে ওই বাসা থেকে বের হয়ে যান। ইটভাটার পাশে কলাবাগানে বেশ কিছু সময় অবস্থান করেন। তখন ওয়াসিমের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে নাজমা ওয়াসিমের কাছ থেকে বিবাহের দেনমোহর হিসেবে তিন লাখ টাকা ফেরতসহ ডিভোর্স চান এবং তা না করলে মামলার ভয় দেখান। একপর্যায়ে রাত আনুমানিক দুইটার দিকে ওয়াসিম রাগান্বিত হয়ে নাজমার গলায় থাকা ওড়না দিয়ে নাজমার গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে কলাবাগানের ভেতরে মাটি দিয়ে ঢেকে রেখে ইটভাটায় রাত্রিযাপন করে ভোরবেলায় কাউকে কিছু না বলে গোপনে পালিয়ে যান।

ওয়াসিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছেন। এ বিষয়ে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।