ইতিহাস জীবনের জরুরি অনুষঙ্গ। একটি জাতি যখন তার ইতিহাস প্রচ্ছন্নভাবে জানতে পারে এবং সেই ইতিহাসকে মাথায় রেখে এগোয়, তখন ভবিষ্যৎ গঠনে তাকে কী করতে হবে, সেই দিকনির্দেশনা সে আপনাআপনিই পেয়ে যায়।

ঘটে যাওয়া ঘটনার অসংখ্য প্রামাণ্য দলিল একত্রিত করে গড়ে তোলা বিমূর্ত চিত্রের অখণ্ড কাঠামোই ইতিহাস। অতীতের কোনো ঘটনার যদি কোনো লিখিত নথিপত্র, ছবি, ভাস্কর্য বা অন্য কোনো প্রামাণিক নজির না থাকে; যদি তা শুধু মুখে মুখে ভাসতে থাকে, তাহলে এক সময় সেই সত্য ঘটনাও তথ্যবিকৃতি ও অতিরঞ্জনের তোড়ে হারিয়ে যায়। তা আর বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাসের মর্যাদা পায় না। বড়জোর তা অতিরঞ্জিত ‘মিথ’, গালগল্প বা ভিত্তিহীন লোককথা হিসেবে টিকে থাকে। সেই মিথের ওপর ভর করে বর্তমান প্রজন্ম ভবিষ্যতের পথে এগোতে পারে না। এ কারণে আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় প্রামাণ্য নথিপত্র সংরক্ষণের ওপর জোর দেওয়া হয়। আর তাই আর্কাইভ ব্যবস্থাকে অপরিহার্য মনে করা হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আর্কাইভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশ পিছিয়ে আছে। সে কারণে নিকট অতীতেরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ছবি কিংবা দালিলিক প্রমাণপত্র যথার্থভাবে সংরক্ষণ হয়নি। ষাটের দশক থেকে নব্বই দশকের ঢাকা শহরের ছবি যদি কেউ খুঁজতে যান তাহলে দেখবেন হাতে গোনা অল্প কিছু ছবি পাওয়া যাচ্ছে। যা-ও পাওয়া যাচ্ছে তা মিলছে কোনো না কোনো আর্কাইভ ব্যবস্থার আওতায়। ফলে অসংখ্য ইতিহাস কালের গলিত গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে।

আনন্দের কথা, আর্কাইভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অন্য অনেক সংস্থা কিংবা সংগঠনের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশের প্রাত্যহিক ঘটনাপঞ্জি তাদের নথিপত্রে সংরক্ষিত থাকে। তার মহাফেজখানায় প্রতিদিন যুক্ত হয় অসংখ্য ঘটনাপ্রবাহের মূল্যবান নথি। ফলে বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাস এক জীবন্ত সত্তার মতো জনমনে তার উপস্থিতি ঘোষণা করে থাকে।

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর প্রধান হিসেবে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি), বাংলাদেশ ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) যেসব অনন্য ভূমিকা রেখেছেন তার প্রামাণিক দলিল সংরক্ষণে বাংলাদেশ পুলিশের মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি বিভাগ অসামান্য নজির স্থাপন করেছে। এই বিভাগের পক্ষ থেকে ‘পরিবর্তনের অভিযাত্রা, নাগরিক অভিমত’, ‘স্বপ্নযাত্রার অগ্রনায়ক, ২০২০ সালে আইজিপির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম’ এবং ‘প্রবাহ’ শিরোনামে তিনটি বই প্রকাশ করেছে।

আইজিপি মহোদয়ের বক্তব্য, কাজ ও নানা ধরনের উদ্যোগের প্রামাণিক দলিল এই তিনটি বই। তিনটি বইয়েরই সম্পাদক বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মোঃ কামরুজ্জামান বিপিএম। নির্বাহী সম্পাদক সহকারী পুলিশ সুপার (মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি) মোঃ ইমরান আহম্মেদ। তাঁদের অনবদ্য সংকলন ও সম্পাদনায় তিনটি বইই বাড়তি উচ্চতায় পাঠকের কাছে ধরা দিয়েছে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আইজিপি হিসেবে ড. বেনজীর আহমেদ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য যেসব কাজ সংবাদমাধ্যমে খবর হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে তার সংকলন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশ পুলিশের ভ্যারিফায়েড পেজে তাঁর দেওয়া বিভিন্ন পোস্টে পাঠকের করা মন্তব্যের সংকলন নিয়েই গ্রন্থগুলো মলাটবন্দী হয়েছে।

বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলোর সংকলন মূলত একটি রেকর্ড হিসেবে কাজ করছে। আজ থেকে ১০ বছর, ২০ বছর বা আরও বেশি সময় পর ২০২১ সালে বাংলাদেশ পুলিশের কার্যক্রম কেমন ছিল তা সম্পর্কে একটি মৌলিক ধারণা পেতে এই বই তিনটি অতি মূল্যবান প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে কাজ করবে।

একজন আইজিপির একটি নির্দিষ্ট সময়ের দায়িত্ব পালনের সচিত্র দলিল হয়ে থাকছে এই বইগুলো। সেদিক থেকে দেখলে এই প্রচেষ্টাকে ইতিহাসের দালিলিক উপাত্ত সংরক্ষণের মহান চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।

ড. বেনজীর আহমেদের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দিন থেকে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের ভ্যারিফায়েড পেজে তাঁকে নিয়ে যেসব পোস্ট দেওয়া হয়েছে এবং সেসব পোস্টে যেসব মন্তব্য এসেছে তা নিয়েই ‘পরিবর্তনের অভিযাত্রা, নাগরিক অভিমত’ শীর্ষক বইটি প্রকাশিত হয়েছে। পুরো বিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত ঠিক তখন মুজিববর্ষ ২০২০ সালে বাংলাদেশ পুলিশের হাল ধরেন ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার)।

করোনা মহামারির পরিবেশেও সঠিক এবং যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশকে এগিয়ে নিতে তিনি স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করেন। পুলিশের আমূল পরিবর্তনের জন্য তিনি বিভিন্ন উদ্ভাবনী, সৃজনশীল ও আধুনিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে থাকেন। তার এই উদ্যোগ ও কার্যক্রম সম্পর্কে বাংলাদেশ পুলিশের ফেসবুক পেজে বিভিন্ন পোস্ট দেওয়া হয়। সেসব পোস্টে দেশের সাধারণ জনগণের অজস্র মতামত ও মন্তব্য আসে। মূলত সেসব মন্তব্য নিয়েই বইটি সংকলিত হয়েছে।

‘স্বপ্নযাত্রার অগ্রনায়ক, ২০২০ সালে আইজিপির উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম’ বইটিতে মূলত ২০২০ সালে ড. বেনজীর আহমেদের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব খবর ছাপা হয়েছে তা সংকলন করা হয়েছে। বইটিতে একই ঘটনায় প্রকাশিত একাধিক সংবাদ থেকে বাছাইকৃত একটি বা দুটি সংবাদ নেওয়া হয়েছে। সংবাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভাষারীতিকে অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। বইটিতে ব্যবহৃত প্রতিটি সংবাদের ক্ষেত্রে কিউআর কোড জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পাঠক চাইলে সেই কোড স্ক্যান করে মূল খবরটি ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিতে পারবেন।

বাংলাদেশ পুলিশের মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি বিভাগের আরেকটি অনবদ্য উপস্থাপনা হলো ‘প্রবাহ’। এই বইটি মূলত ২০২১ সালে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের কার্যক্রম নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের সংকলনগ্রন্থ। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর আধুনিকায়নে তিনি যেসব যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন তার প্রামাণ্য দলিল এই বই। ২০২১ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে কী কী পরিবর্তন হয়েছে, এই বাহিনী কী কী কার্যক্রম চালিয়েছে, তা সম্পর্কে এই বইটি বিশদ ধারণা দেবে।

সব মিলিয়ে এই তিনটি বই বাংলাদেশ পুলিশের একটি সময়ের মহান মহাফেজখানা হিসেবে টিকে থাকবে, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক ইত্তেফাক।