বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এবং ১৪তম সমাবর্তনে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাসস

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চিকিৎসকদের সেবা প্রদানের ব্রত নিয়ে জনগণের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এটি কেবল একটি পেশা নয়, সেবার ব্রত নিয়েই আপনাদেরকে জনগণের পাশে থাকতে হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটাকে শুধু একটা পেশা হিসেবে নয়। আপনারা মানুষের সেবা করেন এবং আমি চাই সেবার ব্রত নিয়েই আপনারা মানুষের পাশে থাকবেন।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ জুন রাজধানীর মহাখালীতে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের (বিসিপিএস) সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এবং ১৪তম সমাবর্তন ২০২২-এর প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন। শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দেন।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিসিপিএস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জাহিদ মালেক বিসিপিএসের সুবর্ণজয়ন্তীর ফেলোশিপ ও স্মারকচিহ্ন গ্রহণ করেন। পরে জাহিদ মালেক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের বিসিপিএস ফেলোদের মধ্যে স্বর্ণপদক এবং দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে সম্মানসূচক ফেলোশিপও তুলে দেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আমাদের চিকিৎসকবৃন্দকে একটা কথা বলব, একজন রোগী যখন একজন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য যায়, সেখানে ওষুধের থেকেও ডাক্তারের দুটো কথা অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে বা তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই এই বিষয়টার দিকেও একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। তিনি বলেন, ডাক্তারের কথাতেই রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যায়, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর আমাদের দেশে গবেষণার একান্ত প্রয়োজন উল্লেখ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এ বিষয়ে চিকিৎসকদের মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেন। সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের জন্য গবেষণা একান্তভাবে প্রয়োজন, সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য আমি সবাইকে আহবান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, আমাদের দেশের আবহাওয়া, জলবায়ু এবং প্রকৃতির সঙ্গে অনেক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেগুলো থেকে মানুষকে মুক্ত করাও আমাদের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদাহরণ দেন, জাতির পিতা সে সময় এই অঞ্চলে মারাত্মক আকারে দেখা দেওয়া কলেরা নিরাময়ে আইসিডিডিআরবি প্রতিষ্ঠা করে সেটাকে একটি উন্নত মানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে যান। তাঁর সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় এসে এর আরও উন্নয়ন করে। ফলে এই অঞ্চল কলেরার প্রাদুর্ভাব থেকে মুক্তি পেয়েছে। পাশাপাশি পোলিওসহ বিভিন্ন রোগের টিকা দিয়ে শিশুকাল থেকেই মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে।

আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা মেধাবী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশের চিকিৎসকেরা যদি বিদেশে গিয়ে এত ভালো করতে পারেন, তাহলে দেশে করবেন না কেন।

আমাদের চিকিৎসকেরা দেশে যেন তাঁদের মেধার যথাযথ বিকাশ ঘটাতে পারেন, সে ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ জন্য যত রকম সহযোগিতা প্রয়োজন আপনারা পাবেন। তিনি বলেন, বিসিপিএসের ফেলোশিপ পাওয়াটা অত্যন্ত সম্মানের। যাঁরা সম্মানিত ফেলো এবং মেম্বারগণ এখানে উপস্থিত আছেন, সবার কাছে আমার এটাই আহবান, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনাদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আপনারা কাজ করে যাবেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার পক্ষ থেকে এইটুকু বলতে পারি, যত ধরনের সহযোগিতা দরকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য, সব ধরনের সহযোগিতা আপনারা আমার কাছ থেকে পাবেন। এটুকু আমি আপনাদের কথা দিতে পারি। তিনি বিদেশ থেকে আগত অতিথিদের অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনারা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখছেন এবং আমি মনে করি, একসঙ্গে কাজ করলে মতবিনিময়ের মাধ্যমে অনেক নতুন অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করা যায়। যা দেশের এবং মানুষের কাছে লাগে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সব সময় এটাই লক্ষ্য, আমাদের দেশের মানুষ সব সময় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাবে। সেটাই আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং সেটা আমরা করে যাব। তিনি বলেন, তাঁর সরকার রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেটে আরও ৩টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা তাঁর সরকারের লক্ষ্য। পাশাপাশি সারা দেশে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে মেডিকেল কলেজ যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

চিকিৎসার মানোন্নয়ন এবং রোগীর সেবার বিষয়টি নিশ্চিত করার আহবান জানান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

সরকারপ্রধান বলেন, এই বিষয়টা আপনাদের দেখতে হবে, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন চিকিৎসাটা যেন আমাদের দেশের মানুষ পেতে পারে। যদিও আমাদের দেশের লোকসংখ্যা অনেক বেশি, রোগীর চাপ অনেক বেশি; তারপরেও আমি বলব বিষয়টি দেখা দরকার। এ সময় অনলাইনভিত্তিক বিশেষায়িত চিকিৎসাব্যবস্থাটা ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে আরও উন্নত করার পরিকল্পনা তাঁর সরকারের রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, লোকজন নিজ নিজ উপজেলায় বসেই যেন বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা পেতে পারে, সে সুযোগও আমরা সৃষ্টি করে দিচ্ছি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার খাদ্য-পুষ্টির নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি জনগণকে রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে মুক্ত রাখতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি সঠিক রোগনির্ণয় এবং মানুষের মাঝে রোগ-ব্যাধি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের অসংক্রামক রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আর জানি না কেন ইদানীং ক্যানসার এবং কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাবটা বেড়ে গেছে। এসব রোগ থেকে মুক্ত থাকার বিষয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং জ্ঞান দান করা প্রয়োজন। সেটা যেমন আপনারা করতে পারেন, তেমনি এই সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রত্যেক বিভাগেই এই বিষয়ভিত্তিক একটি করে হাসপাতাল তৈরি করব। আর জেলা হাসপাতালগুলোতে কিডনি ডায়ালাইসিস এবং হৃদরোগের চিকিৎসা যাতে হতে পারে, সে পদক্ষেপও আমরা ইতোমধ্যে নিয়েছি।

সরকারপ্রধান বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বলতে পারি, আমি কিন্তু মানবতাবোধ নিয়েই এ দেশের মানুষকে সেবা করে যাব, আমার মতো করে আমি সেই সেবাই মানুষকে দিয়ে যাচ্ছি। ক্ষমতা আমার কাছে একটি সুযোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে মূল লক্ষ্য জনগণের সেবা করা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দেওয়া নয়। কাজেই আপনারাও যে যেখানে যে পেশাতেই থাকেন, আপনারা মানবতাবোধ নিয়ে মানুষের পাশে থাকবেন, এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বিসিপিএস সভাপতি অধ্যাপক কাজী দ্বীন মোহাম্মদের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন বিসিপিএসের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক এ এইচ এম তৌহিদুল আনোয়ার চৌধুরী। অনুষ্ঠানে আগত বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন বিসিপিএস সচিব অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ বিল্লাল আলম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিসিপিএসের সিনিয়র সহসভাপতি অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বিসিপিএসের থিম সং এবং বিসিপিএসের কার্যক্রমের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

করোনাকালীন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি চিকিৎসক সমাজকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এ জন্যই তাঁর সরকার মৃত্যুর সংখ্যা একটা সীমার মধ্যে রেখে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে।

চিকিৎসকদের এই সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে গিয়ে যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন, তিনি তাঁদের আত্মার শান্তি কামনার পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।