কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার করোনা ইনসিগনিয়া প্রদান করেছে।
রাজধানীর রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে ৩০ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) এক অনুষ্ঠানে এ ইনসিগনিয়া উন্মোচন করা হয়।
ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি। স্বাগত বক্তব্য দেন অতিরিক্ত আইজি (এফঅ্যান্ডএল) এস এম রুহুল আমিন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত আইজি (এঅ্যান্ডআই) ড. মো. মইনুর রহমান চৌধুরী, ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম, র্যা ব মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিরা, ঢাকাস্থ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধানেরা, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এবং পুলিশ সদস্যরা।
বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনা ইনসিগনিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচনের পর আইজিপি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ইনসিগনিয়া পরিয়ে দেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একে একে আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিরা এবং পুলিশ সদস্যদের করোনা ইনসিগনিয়া পরিয়ে দেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে করোনাকালে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। পরে করোনাকালে পুলিশের অনন্য সাধারণ অবদানের ওপর একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।
বৃত্তাকৃতির দেড় ইঞ্চি-পৌনে দুই ইঞ্চি ব্যাসের কোভিড-১৯ ইনসিগনিয়ায় ব্যবহৃত বাটসহ ছুরি দ্বারা করোনা ভাইরাসকে বিদ্ধ করা হয়েছে, যা ‘অদম্য ও কার্যকরী মোকাবেলার’ প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইনসিগনিয়ায় ব্যবহৃত মুষ্টিবদ্ধ হাত করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সম্মুখ যোদ্ধাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রতীক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, করোনাকালে চিকিৎসকদের পাশাপাশি যারা ফ্রন্টলাইনার (সম্মুখযোদ্ধা) হিসেবে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে পুলিশ ছিল অন্যতম। করোনা মোকাবেলায় কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে যা যা করা প্রয়োজন, সব করেছে পুলিশ। তারা দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা করেননি। করোনাকালে পুলিশ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা আবারও প্রমাণ করলেন, পুলিশ জনগণের পাশে থাকে, ভবিষ্যতেও পাশে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘করোনা কিভাবে আমাদের পর্যুদস্ত করেছে, তা আপনারা দেখেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশে করোনা মোকাবেলায় লকডাউন, কোয়ারেন্টিন বাস্তবায়ন, অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছানো, তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া, করোনায় কেউ মারা গেলে যখন আত্মীয়-স্বজনরা লাশ ফেলে চলে গেছেন তখন লাশের দাফন ও সৎকার করা, এমনকি কৃষকের ধান কাটার ব্যবস্থাও করেছে পুলিশ।’
করোনা মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের অনন্য সাধারণ অবদানের কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় যখন দেশের অনেক বড় বড় হাসপাতাল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে, সেখানে পুলিশ হাসপাতাল করোনা চিকিৎসায় অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। তারা শুধু পুলিশ সদস্যদের নয়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষকেও চিকিৎসা সেবা দিয়েছে। করোনাকালে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সেবা দেওয়ার কাজে নেতৃত্ব দেওয়ায় আইজিপি এবং পুলিশ সদস্যদের বিশেষ ধন্যবাদ জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সভাপতির বক্তব্যে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘করোনাকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পুলিশ এক মহাকাব্যিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পুলিশকে সারা বিশ্বের মত আমাদের দেশেও ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। করোনাকালে দেশ ও জনগণের কল্যাণে বাংলাদেশ পুলিশের ১০৭ জন গর্বিত সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ২৬ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য। আক্রান্তরা সুস্থ হয়েই দেশ ও জনগণের কল্যাণে আবার নিজেদের নিয়োজিত করেছেন।’
আইজিপি আরও বলেন, ‘প্রথম দিকে প্রতিদিন প্রায় ৭০০-৮০০ পুলিশ সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আমাদের পিপিপি নেই, হ্যান্ড গ্লাভস নেই, মাস্ক নেই। তবুও আমরা জনগণের পাশেই ছিলাম। এ জন্য আমাদের সদস্যদের সংক্রমণের হার বেড়ে গিয়েছিল। আমরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণকে সেবা দিয়েছি এবং পরে নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়েছি। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ পুলিশ সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছে।’
পুলিশপ্রধান বলেন, ‘করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ পুলিশের কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। আমরা বাংলাদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে নিযুক্ত উন্নত এবং পার্শ্ববর্তী দেশের পুলিশ লিয়াজোঁ অফিসারদের ডেকে নিয়ে এসে তাদের সাথে বসে করোনা মোকাবেলায় আমাদের দেশের উপযোগী করে বাংলাদেশ পুলিশের জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) তৈরি করেছি। পুলিশ সদস্যদের করোনা চিকিৎসার জন্য একটি বেসরকারি হাসপাতাল ভাড়া করা হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাড়া করে পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা ও কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কমিউনিটি সেন্টারে তাদের থাকার জন্য বিছানা ও আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে ২৫০ শয্যার সাধারণ হাসপাতাল থেকে মাত্র এক মাসের মধ্যে কোভিড হাসপাতালে রূপান্তর করা হয়েছে। আমরা সর্বপ্রথম পুলিশ হাসপাতালে আইভারমেট্রিন ব্যবহার করেছি। বিদেশি হাসপাতালের সাথে পুলিশ হাসপাতাল করোনা চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করেছে। আমরা প্রথম প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করেছি। করোনা চিকিৎসায় পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী সবাই অতিমানবীয় কাজ করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘যত সহজে এ কথাগুলো বলেছি তা করা খুব সহজ ছিল না।’
করোনা ইনসিগনিয়া প্রদান প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, ‘র্যা ব যখন সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করেছে, তখন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখনকার র্যা ব প্রধান হিসেবে আমাকে বলেছেন, আপনারা এত বড় একটা কাজ করলেন, আমি আপনাদের জন্য কিছু করতে চাই। তিনি আমাদের আর্থিক অনুদান দিতে চেয়েছেন, সনদপত্র দিতে চেয়েছেন। তখন আমরা মাননীয় মন্ত্রীকে প্রস্তাব দিলাম যে আমাদেরকে একটি ইনসিগনিয়া প্রদান করেন, যাতে আমরা মর্যাদার সাথে এটা পরতে পারি। পরে উনি আমাদের ইনসিগনিয়া প্রদান করেছেন। এবারও করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যদের অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের করোনা ইনসিগনিয়া প্রদান করেছে। আমি এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। সরকারের দেওয়া এ ইনসিগনিয়া দেশ ও জনগণের পাশে থাকতে পুলিশ সদস্যদের আরও অনুপ্রেরণা যোগাবে।’