কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার আসামিদের একজন। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

এক বছর আগে কেরাণীগঞ্জে কিশোরী মারিয়া (১৭) হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন ও সব আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

বামনশুর পুকুরে ভাসমান মারিয়ার (১৭) লাশের চাঞ্চল্যকর ক্লু-লেস হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন ও সকল আসামী গ্রেফতার।

গত বছরের ১১ জুন সকাল আনুমানিক পৌনে ৮টার সময় জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯ থেকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা পুলিশ খবর পায় যে, কেরাণীগঞ্জ মডেল থানাধীন পশ্চিম বামনশুর জামে মসজিদের সামনের পুকুরে অজ্ঞাতনামা কিশোরীর মৃতদেহ ভেসে আছে।

তাৎক্ষনিকভাবে টহলরত পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত মৃতদেহের সুরতহাল করে হত্যার প্রকৃত কারণ নিরূপনের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (মিডফোর্ড হাসপাতাল) ময়না তদন্তের জন্য পাঠায় ।

পরে চাঞ্চল্যকর ও নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৩ জুন পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করে।
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকেই ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন ও ভিকটিমের নামঠিকানা নিরুপন এবং ঘটনায় জড়িত আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার জন্য কেরাণীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন কবীরের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল ব্যাপক তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় মৃত কিশোরীর বান্ধবী বৃষ্টিকে পাওয়া যায়। তার কাছ থেকে ভিকটিমের নাম মারিয়া (১৭) বলে জানা যায়। তারা একত্রে কামরাঙ্গীরচরে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করত বলে জানায়। ভিকটিমের নাম ছাড়া অন্য কোনও তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনায় ও হত্যার মূল রহস্য উদঘাটনের লক্ষ্যে বিশেষায়িত তদন্ত ইউনিট পিবিআই ঢাকা জেলার কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রায় ১ বছর তদন্ত করার পরও পিবিআই চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে কেরাণীগঞ্জ মডেল থানায় দায়ের করা নয়ন হত্য মামলার ছয়জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে ধৃত আসামিদের মধ্যে সজিব, আলী আকবর, রাকিব ও রিয়াজ নয়ন হত্যার পাশাপাশি মারিয়াকে তারা কিভাবে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ পুকুরে গুম করেছিল সে ব্যাপারে লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। তারা জানান শাওন নামে এক যুবক মারিয়া হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী,যাকে কখনো কেউ সন্দেহ করেনি। এদের মধ্যে সজিব ও রাকিব ইতিমধ্যে নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে নয়ন হত্যার পাশাপাশি মারিয়া হত্যার ব্যাপারেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।

এ অবস্থায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে মারিয়া হত্যা মামলাটি পিবিআই ঢাকা জেলা থেকে আবার কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এরপর ঢাকার পুলিশ সুপার
আসাদুজ্জামান শাওনকে গ্রেপ্তারের জন্য তাৎক্ষনিক নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম, অপস্ অ্যান্ড ট্রাফিক-দক্ষিণ) আমিনুল ইসলামের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এবং কেরাণীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন কবীরের নির্দেশনায় মামলার তদন্তকারী অফিসার অলক কুমার দের নেতৃত্বে এসআই রিয়াজ সহ কেরানীগঞ্জ মডেল থানার একটি চৌকস আভিযানিক দল চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার মূল হোতা শাওনকে তথ্য-প্রযুক্তির সহযোগিতায় শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।

শাওনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় মারিয়া হত্যার দিন রাকিব, বৃষ্টি ও বৃষ্টির বান্ধবী মারিয়াকে নিয়ে খোলামোড়া ঘাট থেকে খোলামোড়া টিনের মসজিদ এলাকার শিয়ালের ঘারা নামক দেয়াল বেষ্টিত একটি জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে আসেন। ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর বৃষ্টি ও মারিয়া ঘটনাস্থলে উপস্থিত সজিব, আলী-আকবর, রিয়াজ, রাকিব ও শাওন সবাই মিলে ইয়াবা সেবন করেন। এইসব দেখে মারিয়া ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকে। তখন শাওনের পরামর্শে রাকিব ও আলী কৌশলে বৃষ্টিকে একা পাঠিয়ে দেন। বৃষ্টি চলে গেলে উপস্থিত সকলে মারিয়াকে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রথমে বুঝানোর চেষ্টা করেন। মারিয়া কোন কথায় রাজি না হলে সবাই একত্রে মারিয়াকে মাটিতে ফেলে পর্যায়ক্রমে গণধর্ষণ করেন। মারিয়া তখন উত্তেজিত হয়ে চলে যাওয়ার সময় তাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলে হুমকি দেয়। একথা শুনে শাওন মারিয়াকে ধরে মাটিতে ফেলে দেন ও সাথে থাকা উড়না দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। রাকিব, রিয়াজ, সজিব মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য মারিয়ার হাত পা চেপে ধরে রাখেন। মারিয়ার মৃত্যু হয়েছে বুঝতে পারার পর শাওন, রিয়াজ ও আলী-আকবর মারিয়ার লাশ ধরাধরি করে শিয়ালের ঘারার গেইটের কাছে আসেন। গেইটের উপরে বসে থাকা সজিব ও রাকিবের কাছে লাশটি উঠিয়ে দেন। তারপর লাশটি নিয়ে রাকিবের অটোতে ওঠান। সকলে একত্রে লাশটি গুম করার অভিপ্রায়ে বুড়িগঙ্গার দিকে রওনা দেন। পথিমধ্যে নাইট গার্ডের কথা মাথায় আসলে রাকিব লাশটি নিয়ে বামনশুর মসজিদের সামনে পুকুরের কাছে নিয়ে যান। আলী ও সজিব রাস্তা পাহারা দেন ,বাকি তিনজন মিলে মারিয়ার লাশটি পুকুরের পানিতে গুম করার উদ্দেশ্যে ফেলে দেন।