সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। ছবি: পুলিশ নিউজ

মৌলভীবাজার তথা বৃহত্তর সিলেটের মানুষের কাছে আজ একটি বিশেষ দিন, আনন্দের দিন। কেননা আজ মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খান ও মাননীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের উপস্থিতিতে জুড়ী থানা ভবন উদ্বোধন করা হচ্ছে।

৭ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৫০ টাকা ব্যয়ে নির্মিত থানা ভবনটিতে সব কার্যক্রম চালু হলে গোটা এলাকায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর মধ্য দিয়ে আরও আধুনিক ও উন্নত থানা হিসেবে জুড়ী থানা তার কার্যক্রম চালাতে পারবে।
জুড়ী থানার আজকের এই অবস্থানে আসতে দীর্ঘ সময় ও দীর্ঘ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া পার হতে হয়েছে। এ ছাড়া এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সেই ইতিহাসের একটি শিকড়সন্ধানী স্মারকগ্রন্থ সিলেট রেঞ্জ পুলিশ ও মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে প্রকাশ করা হচ্ছে। স্মারকগ্রন্থটির শিরোনাম ‘একটি আধুনিক থানার জন্মকথা’।

গ্রন্থটিতে মৌলভীবাজার তথা জুড়ী থানা এলাকার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে। সচিত্র ও তথ্যসংবলিত আকারে সফলতার সঙ্গে থানা-পুলিশের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে বেশ কিছু করণীয় বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। এটি করতে গিয়ে বাস্তব জ্ঞান ও আইনের দিকটি মাথায় রাখা হয়েছে।

থানায় কর্মরত এবং থানায় নবাগত পুলিশ সদস্যরা বইটি পড়ে জুড়ী থানা এলাকা ও থানা পুলিশিং বিষয়ে সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারবেন। পুলিশ সদস্যদের পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে বইটি সহায়ক হবে। সাধারণ পাঠকও বইটি পড়ে জুড়ী এলাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যসহ পুলিশি কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা পাবেন।

‘একটি আধুনিক থানার জন্মকথা’র সুলুকসন্ধান করতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ইতিহাসে। এর জন্য একবার পেছন ফিরে তাকাতে হবে।
সিলেটের ইতিহাসের কথা আমাদের অনেকেরই জানা। ১৭৭২ সালে সিলেট জেলার জন্ম হয়ে তা শত বছর ছিল বাংলার অধীনে। ১৮৭৪ সালে সিলেট জেলা চলে যায় আসাম প্রদেশের অধীনে।

বঙ্গভঙ্গের অল্প কয়েক বছর পর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সিলেট জেলা আসামের অধীনেই ছিল। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত সিলেটের ছিল চারটি মহকুমা (শ্রীহট্ট সদর, করিমগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ)। ১৮৮২ সালে শ্রীহট্ট সদর ভেঙে শ্রীহট্ট দক্ষিণ নামে আরেকটি মহকুমা তৈরি করা হয়।

সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় করিমগঞ্জ আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় করিমগঞ্জ সদর থানা দুই ভাগ হয়ে অর্ধেক এলাকা জকিগঞ্জ থানা নামে শ্রীহট্ট সদর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত করিমগঞ্জ মহকুমার অধীনে জলঢুপ ছিল একটি থানা। এ বছর থানাটি বিলুপ্ত হয়ে বিয়ানীবাজার ও বড়লেখা থানা নামে দুটি থানা আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় থানা দুটি করিমগঞ্জ মহকুমা থেকে আলাদা হয়ে বিয়ানীবাজার শ্রীহট্ট সদরের অধীনে চলে আসে; বড়লেখা চলে যায় শ্রীহট্ট দক্ষিণ মহকুমার অধীনে। দেশভাগের পর সিলেট জেলার অধীনে চারটি মহকুমা রয়ে যায়। এগুলো হলো শ্রীহট্ট সদর, শ্রীহট্ট দক্ষিণ, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ।

সিলেট জেলা সৃষ্টির পর থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিল শ্রীহট্ট। ১৯৬০ সালে শ্রীহট্ট দক্ষিণ মহকুমার নাম পরিবর্তন হয়ে মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহর নামানুসারে হয় মৌলভীবাজার। ১৯৮৪ সালে মৌলভীবাজার জেলায় উন্নীত হয়।

দীর্ঘদিন ধরে বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার থানা ছিল ছয়টি। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন থানা শ্রীমঙ্গল, যা ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মৌলভীবাজার সদর থানা, রাজনগর ও কুলাউড়া থানা তিনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৯২২ সালে। বড়লেখা থানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪০ সালে এবং কমলগঞ্জ থানা ১৯৮৩ সালে।

জুড়ী এলাকার নামকরণ করা হয় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বয়ে আসা ‘জুড়ী’ নদীর নামানুসারে। নদীটি বর্তমান জুড়ী থানা এলাকার মধ্য দিয়ে হাকালুকি হাওর হয়ে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলেছে।

নদীর দুই পাশেই জুড়ী থানা এলাকার বিস্তৃতি। কুলাউড়া থানার অধীনে জুড়ী নামে একটি পুলিশ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৯ সালে ক্যাম্পটি তদন্ত কেন্দ্রে উন্নীত হয়।

কুলাউড়া থানার ১৭টি ইউনিয়ন এবং বড়লেখা থানার ১২টি ইউনিয়ন থাকায় বড় দুটি থানার মাঝখানে অবস্থিত জুড়ী এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে আলাদা একটি থানা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভূত হয়।

এমন বাস্তবতায় ২০০৪ সালের ২৬ আগস্ট প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) ৯০তম বৈঠকে বাংলাদেশের ৪৭১তম প্রাশাসনিক উপজেলা হিসেবে জুড়ী থানার আত্মপ্রকাশ ঘটে।
থানা প্রতিষ্ঠার সময়ে এর ইউনিয়ন ধরা হয় আটটি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বড়লেখা থানার চারটি (পূর্বজুড়ী, পশ্চিমজুড়ী, দক্ষিণভাগ ও সুজানগর ইউনিয়ন) এবং কুলাউড়া থানার চারটি (জায়ফরনগর, গোয়ালবাড়ী, সাগরনাল ও ফুলতলা ইউনিয়ন)। পরবর্তীকালে মহামান্য হাইকোর্টে করা রিটের আলোকে বড়লেখা থানার দক্ষিণভাগ ও সুজানগর ইউনিয়ন বাদ পড়ে বাকি ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে বর্তমানে থানাটির কার্যক্রম চলছে।
ইউনিয়নগুলো হলো পূর্বজুড়ী, পশ্চিমজুড়ী, জায়ফরনগর, গোয়ালবাড়ী, সাগরনাল ও ফুলতলা। প্রতিটি ইউনিয়নকে একটি পুলিশ ইউনিট হিসেবে বিবেচনা করে বিট হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে বিট পুলিশিং কার্যক্রম চলছে।

পুলিশিংকে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়াই বিট পুলিশিংয়ের মূল উদ্দেশ্য।

জুড়ী থানার উত্তরে বড়লেখা থানা, দক্ষিণে কুলাউড়া থানা, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যের সীমানা এবং পশ্চিমে হাকালুকি হাওর। থানা এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। এখানে রয়েছে ১১টি চা-বাগান, কমলাবাগান, খাসিয়াপল্লি, প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক এলাকা ও হাকালুকি হাওরের একাংশ।

পূর্বে কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর হয়ে যে রেললাইন ভারতের করিমগঞ্জ পর্যন্ত ছিল, তা আবার চালু হতে যাচ্ছে। জুড়ীতে একটি রেলওয়ে স্টেশন হবে। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এলএ কেস নং-১/২০১২-২০১৩ মূলে জুড়ী উপজেলার বাছিরপুর মৌজায় কুলাউড়া-বড়লেখা সড়কের সঙ্গে ১ একর জমি জুড়ী থানার নামে অধিগ্রহণ করা হয়।
পুলিশ বিভাগের ১০১টি জরাজীর্ণ থানা ভবন টাইপ প্ল্যানে নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ছয়তলা ভিতবিশিষ্ট চারতলা আধুনিক জুড়ী থানার যে ভবন আজ উদ্বোধন করা হচ্ছে, তা নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে দরপত্র আহ্বান করা হয়। পরবর্তী সময়ে ৭ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৫০ টাকা ব্যয়ে থানা ভবনটি নির্মাণ হয়।
ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে রয়েছে অফিসকক্ষ, আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধা।
ভবনের সামনে রয়েছে সবুজ মাঠ ও সুদৃশ্য ফুলের বাগান। থানা আঙিনায় প্রবেশমুখেই বাম পাশে রয়েছে একটি নয়নাভিরাম ছোট পুকুর। থানার সেবাপ্রত্যাশীরা আঙিনা ও ভবনে প্রবেশের পর এর বিভিন্ন সেবামূলক ব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হবেন।

বর্তমানে যাঁরা জুড়ী থানা-পুলিশে কাজ করছেন এবং ভবিষ্যতেও যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের কাছে প্রত্যাশা, সুন্দর ভবনে অবস্থান করে জনগণকে উন্নত ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত ও কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করবেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নত করা এবং পুলিশকে উন্নত সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) মহোদয় এ ধারাকে বেগবান করার জন্য দিনরাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।

মাঠপর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সরকারের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের সবার শ্রম সার্থক হোক।

মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, ডিআইজি, সিলেট রেঞ্জ