সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে মহাসড়কের পাশ থেকে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে সিরাজগঞ্জ পিবিআই। আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি এবং গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করে অপরাধী চক্রকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। পিবিআই জানিয়েছে, এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আসামি মো. ইছার উদ্দিন ওরফে এছার ছয়জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ঘটনার বিবরণ
পিবিআই সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর রাত আনুমানিক দেড়টার সময় স্থানীয় পথচারীরা হাটিকুমরুলের পাটধারীতে মহাসড়কের পাশে দুই জনকে হাত-পা বাঁধা এবং মুখে স্কচটেপ লাগানো অবস্থায় দেখতে পেয়ে ৯৯৯ এ ফোন দেয়।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একজনকে মৃত এবং অপর জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে সলঙ্গা থানা-পুলিশকে সংবাদ দেন। সলঙ্গা থানা পুলিশ মৃতের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে লাশসহ অপর ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদে অক্ষত ব্যক্তি নিজের নাম শামসুল হক (৪০) এবং মৃত ব্যক্তির নাম নূর মোহাম্মদ (৩৮) বলে জানান। তাঁদের বাড়ি নাটোরের নলডাঙ্গার ঠাকুর লক্ষ্মীকোল গ্রামে। তাঁরা পেঁয়াজ ব্যবসায়ী। পরে মৃত নূর মোহাম্মদের ভগ্নিপতি জাকির হোসেন বাদী হয়ে সলঙ্গা থানায় অভিযোগ দায়ের করলে অফিসার ইনচার্জ সলঙ্গা থানা একটি নিয়মিত মামলা করেন।
মামলার তদন্ত
পিবিআই সিরাজগঞ্জ জেলা টিম মামলাটির ছায়া তদন্তের একপর্যায়ে ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর মামলাটি স্ব-উদ্যোগে অধিগ্রহণ করে।
ডিআইজি (পিবিআই) বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার), পিপিএম এর সঠিক তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় পিবিআই সিরাজগঞ্জ ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার রেজাউল করিমের সার্বিক তদারকিতে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আশিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করেন।
মামলাটি তদন্তকালে পিবিআই, সিরাজগঞ্জ টিম জানতে পারে, ঘটনার তারিখ ও সময়ে ব্যবসায়ী নূর মোহাম্মদ যে স্থানে পেঁয়াজ লোড করেছিলেন; সেই জায়গায় নাটোরের ভবানীপুরের দুর্ধর্ষ ডাকাত ইছার উদ্দিন এছারের অবস্থান ছিল। একপর্যায়ে পিবিআই জানতে পারে যে, এছার গত এপ্রিলে একটি ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কুমিল্লা কারাগারে আছেন।
এছারকে জিজ্ঞাসাবাদ
আইনি প্রক্রিয়া শেষে এছারকে ১১ জানুয়ারি পাঁচ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এছার ২০/২২ বছর ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়কে ডাকাতি করেন। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর দুই সহযোগী ফোন করে একটি বড় কাজ আছে বলে জানায়। সেই পরিকল্পনামতো এছার একজন সহযোগীকে নিয়ে সন্ধ্যার আগেই নাটোরে পৌঁছান। অজ্ঞাতনামা ট্রাক ড্রাইভারসহ অন্য দুই সহযোগী তাঁর জন্য আগে থেকেই নাটোর মাদ্রাসা মোড়ে অপেক্ষা করতে থাকে। পরে সবাই মিলে নাটোর মাদ্রাসা মোড় থেকে সেই ট্রাক নিয়ে বগুড়া রোডের দিকে এগোতে থাকেন। অপর একজন সহযোগী ঘটনাস্থলে অবস্থান করে মালামলের ওপরে নজর রাখে। ট্রাকটি ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পৌঁছিলে মালামালের ওপর নজর রাখা অপর সহযোগী মালামাল ঠিক আছে মর্মে গ্রিন সিগন্যাল দেয়। তাঁর গ্রিন সিগন্যালে ট্রাকটি সন্ধ্যা ৬টার দিকে মালামালের কাছে পৌঁছানো মাত্র বাচ্চু নামক একজন লেবার ৩৬ বস্তা পেঁয়াজ বগুড়া যাবে মর্মে ট্রাকটি থামায়। ট্রাক ড্রাইভার দামদর মিটিয়ে সবাই ট্রাক হতে নিচে নামে। একজন সহযোগী পেঁয়াজ লোডের সাথে থাকে, অন্য দুজন একটু সামনে আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। ট্রাক লোড হতে প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লাগে। তারপর পেঁয়াজ ব্যাপারীরা ট্রাকের বডিতে পেঁয়াজের বস্তার ওপর উঠে বসে। পরে ট্রাকটি বগুড়ার উদ্দেশে রওনা করার সময় ঘটনাস্থলের আনুমানিক ১০ গজ সামনে থেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত তিনজন ডাকাত পেঁয়াজ ব্যাপারীদের সাথে ট্রাকের পেছনে উঠে বসে। তখন ব্যাপারী নূর মোহাম্মদ ড্রাইভারকে তাদের সাথে বসা তিনজনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে ড্রাইভার জানান, তাঁরা তার পরিচিত, সামনেই নেমে যাবে। কিন্তু পথে একপর্যায়ে এছার তাঁর সহযোগীদের নিয়ে ব্যাপারীদের এলোপাতাড়ি মারপিট শুরু করে। ডাকাতদের মারপিটে মাথায় মারাত্মক জখম হয়ে নুর মোহাম্মদ মারা যান। ডাকাতেরা ব্যাপারীদের মোবাইল ও নগদ টাকা নিয়ে নেয়। পরে নূর মোহাম্মদ ও শামসুল হককে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে দিয়ে পেঁয়াজসহ ট্রাক নিয়ে ঢাকার দিকে চলে যায়। এরপর ডাকাতেরা পেঁয়াজগুলো গাজীপুর এলাকায় বিক্রি করে। পুরো ঘটনায় মোট ৬ জন ডাকাত অংশগ্রহণ করেছিল।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
আসামি এছারকে ১৩ জানুয়ারি আদালতে হাজির করা হলে তিনি নিজেকে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত অপর আসামিদের নাম উল্লেখ করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেন।