সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার রহস্য উদঘাটনের তথ্য জানায় পিবিআই। ছবি: পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর)

প্রায় ছয় বছর আগে উদ্ধার করা অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ শনাক্ত ও মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। গতকাল শুক্রবার রেজাউল করিম নামের ওই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পিবিআই সূত্র জানায়, আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে ২০১৫ সালের ৩ মে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসের ট্রাঙ্কে অজ্ঞাতনামা এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। ওই দিন সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রাম এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট কেটে একজন ব্যক্তি ওই ট্রাঙ্ক তুলে দিয়েছিলেন বাসের বক্সে। তিনি বাসচালকের সহকারীকে বলেছিলেন, সামনের ভাটিয়ারী কাউন্টার থেকে ওই টিকিটের যাত্রী উঠবে। ভাটিয়ারী কাউন্টারে ওই টিকিটের যাত্রী না ওঠায় বাসটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে এবং সন্ধ্যা ছয়টার দিকে গাবতলীতে পৌঁছায়। সব যাত্রী জিনিসপত্র নিয়ে নেমে যায়। পরে বাসচালকের সহকারী দেখেন, ট্রাঙ্ক বাসের বক্সে মালিকবিহীন পড়ে রয়েছে। তখন বাসের কর্মীরা ট্রাঙ্কটি নামাতে গিয়ে দেখেন, সেটি খুব ভারী। তাঁদের সন্দেহ হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে দারুস সালাম থানায় খবর দেওয়া হয়। থানা-পুলিশ হাজির হয়ে ট্রাঙ্কটি খুলে অজ্ঞাতনামা তরুণীর লাশ দেখতে পান। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় অজ্ঞাতপরিচয় লাশ হিসেবে দাফন করা হয়। কেউ বাদী না হওয়ায় থানা-পুলিশের পক্ষে এসআই জাহানুর আলী বাদী হয়ে ওই দিন দারুস সালাম থানায় মামলা করেন।

প্রায় তিন মাস থানা-পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে। থানা-পুলিশের পরে সিআইডি দীর্ঘ চার বছর তদন্ত করে। কিন্তু লাশের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় এবং হত্যার রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ওই প্রতিবেদন গ্রহণ না করে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। এরপর পিবিআই ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের বিপিএম (বার), পিপিএম নির্দেশে পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ওই মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) ইউনিট ইনচার্জ মো. জাহাঙ্গীর আলম, বিশেষ পুলিশ সুপারের তত্ত্বাবধানে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ ইন্সপেক্টর আশরাফুজ্জামান লাশ শনাক্ত করার জন্য প্রচলিত সব পদ্ধতি প্রয়োগ করে। ডিআইজি পিবিআই মহোদয়ের বিশেষ নির্দেশনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সশরীরে চট্টগ্রাম মেট্রো এবং জেলা এলাকার সব থানার ২০১৫ সালের নথিভুক্ত নিখোঁজ জিডি অনুসন্ধান করে তথ্য নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা এক সপ্তাহ নিরলস পরিশ্রম করে ওই সময়ে কাছাকাছি দশ-বারোটি নিখোঁজ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) তথ্য উদঘাটন করেন। ২০১৫ সালের ১০ জুন পাহাড়তলী থানায় নথিভুক্ত ৫৯৯ নম্বর জিডিতে দেখা যায়, শম্পা বেগম নামের এক নারী নিখোঁজ হয়েছেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে। তিনি খুলনার দৌলতপুর থানাধীন দেওয়ানা উত্তরপাড়া গ্ৰামের ইলিয়াস শেখের মেয়ে। জিডিটি করেছেন নিখোঁজ শম্পা বেগমের বোনের স্বামী আবদুল মান্নান।

ওই জিডির সূত্র ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তা আবদুল মান্নান ও নিখোঁজ শম্পা বেগমের বাবা ইলিয়াস শেখের (অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য) সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ২০১৩ সালে রেজাউল করিম স্বপন নামের এক ব্যক্তি (অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনী সদস্য) খুলনা তিতুমীর নৌঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি হাসপাতালে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতেন। হাসপাতালে ইলিয়াস শেখের স্ত্রীর চিকিৎসাকালীন তাঁদের মেয়ে শম্পা বেগমের সঙ্গে রেজাউলের পরিচয় হয়। ওই পরিচয়ের সূত্রে প্রথমে প্রেম এবং পরে শম্পা তাঁকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে তিনি বদলি হয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন। এরপর শম্পাও কিছুদিন পরে চট্টগ্রামে চলে যান। চট্টগ্রামে শম্পা তাঁর এক ফুফুর বাসায় কিছুদিন থাকেন। এরপর ফয়’স লেক এলাকায় একটি হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করেন। পরবর্তীকালে পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আনোয়ার হোসেনের টিনশেড বাড়ির একটি বাসায় সাবলেট নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এভাবে তাঁরা ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত একত্রে বসবাস করেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলেও বিয়ে করেননি।

পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিলে রেজাউল করিম স্বপন শম্পাকে গত ২০১৫ সালের ২ মে গভীর রাতে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। রেজাউল লাশ গোপন করার উদ্দেশ্যে একটি ট্রাঙ্কে ভর্তি করে ঢাকাগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাসে তুলে দেন এবং শম্পাকে খুলনার বাসে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানান। পরে শম্পাকে না পেয়ে শম্পার ভগ্নিপতি আবদুল মান্নান পাহাড়তলী থানায় জিডিটি করেন। এ ছাড়া শম্পার বাবা ২৭ মে আসামি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম অফিসে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। গোপন তদন্তের ভিত্তিতে জানা যায়, ওই আসামিকে তার বাহিনী অপরাধ সংশ্লিষ্টতার কারণে ২০১৯ সালে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে পিবিআই। একটি চৌকস দল নিরলসভাবে পরিশ্রম করে লাশের পরিচয় শনাক্ত ও মূল আসামি রেজাউল করিম স্বপনকে গতকাল শুক্রবার ভোরে কুমিল্লা জেলার ইপিজেড এলাকায় ভাড়া বাসা থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। আসামি রেজাউল ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি প্রদান করেছেন।