ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে শনিবারের যান চলাচল।

মহামারির বিধিনিষেধহীন ঈদে সড়কে যাত্রীর চাপ বেড়ে বড় ধরনের সঙ্কটের আশঙ্কা করা হলেও তেমনটি ঘটেনি।

গত শুক্রবার থেকে শুরু করে রোববার পর্যন্ত ঢাকা থেকে বিভিন্নমুখী সড়কে চলাচল মোটামুটি নির্বিঘ্নই ছিল।

ঢাকা থেকে উত্তরের পথে গাজীপুর-টাঙ্গাইলে, ময়মনসিংহের পথে গাজীপুরে, চট্টগ্রামের পথে মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা এবং কুমিল্লার কিছু এলাকা এবং খুলনা-বরিশালের পথে দুই ফেরিঘাটে যানজটের শঙ্কা ছিল। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি।

ঠাকুরগাঁওগামী মুনিয়া ইসলাম ঢাকা থেকে শনিবার ভোরে রওনা হয়ে নয় ঘণ্টায় পৌঁছান। বেসরকারি একটি সংস্থার এই কর্মকর্তা বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়েও তো ১০ ঘণ্টা লাগে। এবার একেবারে রেকর্ড। তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছি। গত ১০ বছরে কখনো এত স্বস্তিতে আসতে পারিনি।’

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী ফয়সাল আহমেদ শনিবার রাত ১২টায় রওনা হয়ে ভোরেই পৌঁছে যান। কোথাও যানজটে পড়তে হয়নি বলে জানান তিনি।

শিমুলিয়া ও পাটুরিয়ায় ফেরি পারাপারেও বড় ধরনের কোনো জটিলতা দেখা যায়নি। কিছুটা দেরি হলেও ঘাটে ফেরি পাওয়া যাচ্ছে।

শিমুলিয়ায় ফেরিতে উঠতে অপেক্ষায় বাস
রোববার সকালে বাসে ঢাকা থেকে রাজশাহীর পথে রওনা হওয়া আবুল কাশেম নামের একজন বলেন, ‘ঈদে প্রতিবছর বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়কে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়ে থাকতে হতো। কিন্তু এ বছর এ মহাসড়কে কোনো যানজট নেই। আমরা সঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছাতে পারব বলে মনে হচ্ছে।’

রোববার রাতে ঢাকার কল্যাণপুরে গিয়ে দেখা যায়, বাস দাঁড়িয়ে থাকলেও যাত্রী নেই। যাত্রীর জন্য হাঁকডাক ছিল পরিবহনকর্মীদের।

শ্যামলী এনআর পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক মো. জামান বলেন, ‘এবার ঈদের আগে রাস্তা তুলনামূলক ফাঁকা থাকায় অনেকগুলো গাড়ি সময়ের আগেই ঢাকায় ফিরতে পেরেছে। যে কারণে কিছু বাড়তি ট্রিপ দেওয়া যাচ্ছে।’

অন্য সময় সড়কে যানজটে বাস আটকে থাকায় ট্রিপ সামলাতে হিমশিম খেতে হতো পরিবহনকর্মীদের। আর যাত্রীদেরও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। 

কী কারণে এবার ঈদযাত্রা ব্যতিক্রম, সেই প্রশ্নে মহাসড়ক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলছেন, তাঁরা যানজটপ্রবণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেখানে যেন সমস্যা না হয়, তার আগাম ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

সিরাজগঞ্জের সড়কে এবার সমস্যা নেই।

সিরাজগঞ্জের সড়কে এবার সমস্যা নেই

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এবারের ঈদযাত্রায় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সড়কের অবস্থা ভালো।

মানুষের ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য, পরিবহনসংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতার কথাও বলেন তিনি।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত দুই বছর ঈদের সময় ছিল নানা বিধিনিষেধ। ফলে অনেকেই বাড়ি গিয়ে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করতে পারেননি।

এবার সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতিতে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় ঈদের সময় প্রতিদিন ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়বেন বলে ধারণা দিয়েছিল যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

ঈদের সময় প্রতিদিন ঢাকা ছাড়বে ৩০ লাখ মানুষ: জরিপ  

দেশের পরিবহনব্যবস্থায় দিনে ১৬ লাখ যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা থাকায় অন্যদের বাড়ি ফেরার সঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠার শঙ্কা ছিল। সঙ্গে যোগ হয় সড়কের নানা অব্যবস্থাপনা।

কিন্তু ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার রোববার মোবাইল সিম গমনাগমনের যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে ধারণা করা যায়, অতসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়েননি।

তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত চার দিনে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের হাতে ছিল ৭৩ লাখের বেশি মোবাইল ফোন সিম।

সিমের গমনাগমন দিয়ে ব্যক্তির সংখ্যা নিরূপণ না হলেও একটা ধারণা পাওয়া যায়।
চার দিনে ঢাকার বাইরে ছিল ৭৩ লাখের বেশি মোবাইল সিম।

ঈদযাত্রা শুরু: ট্রেনে দেরি, বাসে ভিড় কম হলেও বেশি লঞ্চে  

এবার ঈদের ছুটিও সড়কে চাপ কমাতে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।

এবার সরকারনির্ধারিত ঈদুল ফিতরের ছুটি ২ থেকে ৪ মে, অর্থাৎ সোম থেকে বুধবার। কিন্তু তার আগে ১ মে রোববার মে দিবসের ছুটি, তার আগের দুদিন আবার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে গণপরিবহনে বাড়ি যাওয়ার চাপ এক দিনে না পড়ে ভাগ হয়ে যায়।

সেই কথাই বলেন শ্যামলী এনআর পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক জামান। ‘এবারের ছুটিটা লম্বা থাকায় অনেক সময় ধরে মানুষ বাড়ি গেছে। যার কারণে শেষ সময়ে তেমন যাত্রী নেই।’

ঈদের দুদিন আগে রোববার রাতে ঢাকার কল্যাণপুরে বাস দাঁড়িয়ে থাকলেও যাত্রী কম ছিল।

ঈদের দুদিন আগে যাত্রী না থাকার দৃশ্যটি কল্যাণপুরে পরিচিত নয়, যা দেখা গেল রোববার রাতে, যখন ঘোষণা এসেছে যে মঙ্গলবার উদযাপিত হবে ঈদ।

একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী গোলাম রসুল শ্যামলী পরিবহনের টিকিট পেয়ে বললেন, প্রতিবার চাঁদরাতে বাড়ি যান ইঞ্জিন কভার বা খুব বেশি হলে বাসের শেষ সারিতে সিট পেয়ে, তা আবার বেশি দামে। এবার রংপুরের টিকিট ৭০০ টাকায় পেয়েছেন, তা-ও সিট সামনের দিকে।

হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক মো. সাব্বির জানান, রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরগামী ৩৭ আসনের বাসটির ২৬টি টিকিট রাত ৯টা পর্যন্ত বিক্রি করতে পেরেছেন।

গ্রামীণ পরিবহনের নওগাঁগামী একটি বাসে ১৫ জন যাত্রীও ছিল না। বাসের হেলপার আতিকুর বলেন, এবার বাজারের ভাবগতি ভালো না। ঈদের আগে কল্যাণপুরেই গাড়ি (যাত্রীতে) ভরে যায়।

রোববার রাতে কল্যাণপুরে বাস দাঁড়িয়ে থাকলেও যাত্রী কম।

‘যাত্রী ডাইকা আনা লাগতাছে’  

রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালে একটু ভিড় দেখলেই লাঠি হাতে ছুটে যাচ্ছিল পুলিশ।

কল্যাণপুরে সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে ছিল, সেগুলোকে সুশৃঙ্খল করতে চারজন পুলিশ সদস্যকে ছোটাছুটি করতে দেখা গেল।

মহাসড়কেও পুলিশ এমন তৎপর বলে দাবি করলেন হাইওয়ে পুলিশের এসপি রহমত উল্লাহ অপু।

তিনি বলেন, মহাসড়কের কোনো কোনো পয়েন্টে যানজট হয়, আমরা সেই জায়গাগুলো চিহ্নিত করে কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিয়েছি। পর্যাপ্ত ফোর্স নিযুক্ত করে আমরা সার্বক্ষণিক তদারক করছি বলেই এবার যাত্রীদের যানজটে পড়তে হয়নি, তাই দেশের মানুষের ঈদযাত্রা স্বস্তির হয়েছে।

উত্তরাঞ্চলে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সিরাজগঞ্জের মহাসড়কে প্রায় ৬০০ পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। তারা যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সার্বক্ষণিক কাজ করছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সেই পথে যানজটের কেন্দ্র ছিল ত্রুটিপূর্ণ নলকা সেতু। এর কারণে প্রায়ই উত্তরাঞ্চলগামীদের যানজটের দুর্ভোগে পড়তে হতো। এবার নলকা সেতুর পাশেই নতুন সেতুর একটি লেন খুলে দেওয়ায় যান চলাচল বিঘ্নিত হয়নি।

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার ও সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম বলেন, যাত্রী আর চালকদের যানজটের যে শঙ্কা আর উৎকণ্ঠা ছিল, তা যেন বাস্তবে রূপ না নেয়, তা মাথায় নিয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণের ফলে মানুষ স্বস্তিতেই বাড়িতে যেতে পারছেন। 

মহাসড়কে দুর্ভোগ কমাতে এবার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেন টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার। এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড় পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার সড়ক দুই লেন। সড়কের তুলনায় অন্তত ১০ গুণ বেশি গাড়ির চাপ থাকায় এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ওয়ানওয়েতে যানবাহন চলাচল করে। শুধু উত্তরাঞ্চলগামী যানবাহনের জন্য সড়কের এ অংশ বরাদ্দ করা হয়।

ঢাকাগামী যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতু পার হয়ে গোলচত্বর দিয়ে অন্তত ২৮ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে গোবিন্দাসী ও ভূঞাপুর হয়ে এলেঙ্গায় ঢোকে। এতে যানজট অনেকটা কমে যায়।

সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, উত্তরবঙ্গের দিকে সব সময় যে সমস্যা হয়, সেটা ওভারকাম করেছি। সেখানে নলকা ছিল দীর্ঘদিনের একটা সমস্যা। আমরা নলকা সেতু করে ফেলেছি। কাজে সেখানে কোনো সঙ্কট হবে বলে আমার মনে হয় না।

গাজীপুরে সড়কে চাপ থাকলেও আটকে যায়নি।

গাজীপুরের যে সমস্যা ছিল, আমার মনে হয় এবার আর সেই সঙ্কট হবে না। আমরা তিনটা ফ্লাইওভার খুলে দিয়েছি গাজীপুরে। সেখানে এখন নিয়মিত গাড়ি চলছে।

তিনি বলেন, সড়কের জন্য কোথাও যাতে কোনো জনদুর্ভোগ না হয়, সে জন্য সতর্ক থাকার পাশাপাশি মাঠপর্যায়েও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
‘মহানগরীর এক্সিট এবং এন্ট্রি পয়েন্টগুলোসহ যানজটপ্রবণ মোড়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশ, জেলা প্রশাসন, আনসার, উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণেই এবার খারাপ সংবাদ পাচ্ছি না।

এবার ঢাকা থেকে ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি ছিল লক্ষণীয়। সেটাও বাসের ওপর চাপ কমাতে ভূমিকা রেখেছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে যানবাহন পারাপারের ফেরিগুলোও সচল রয়েছে বলে সেখানে যানজটে আগের মতো দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে হচ্ছে না বাসযাত্রীদের।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ফেরিতে একেবারে ভোগান্তি নেই, সে কথা বলা যাবে না। শিমুলিয়া ঘাটে যানবাহনের চাপ বেশি, সেখানে ভোগান্তি আছে। তবে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, আরিচা ঘাটে কোনো ভোগান্তি নেই।

যানবাহনের চাপ বেশি, তবে সুশৃঙ্খলভাবে আমরা সেবাটা দেওয়ার চেষ্টা করছি। যার কারণে কিছুটা ভোগান্তি থাকলেও যাত্রীরা স্বস্তির যাত্রা হিসেবেই নিচ্ছে।

আর ওবায়দুল কাদের বলছেন, ‘আমি তো বহুদিন ধরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। এবারের মতো স্বস্তির যাত্রা বহু বছর পর হয়েছে।’
সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম