শেরপুর জেলা পুলিশের উদ্যোগে পুলিশ লাইনস মাল্টিপারপাস শেডে বুধবার সন্ধ্যায় মঞ্চায়িত ‘সূর্যদীর গল্প’ নাটকের একটি দৃশ্য। ছবি: শেরপুর জেলা পুলিশ

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর সদর উপজেলার ঐতিহাসিক সূর্যদী গণহত্যার ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘সূর্যদীর গল্প’ নাটকটি শেরপুর জেলা পুলিশের উদ্যোগে দ্বিতীয় মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

পুলিশ লাইনস মাল্টিপারপাস শেডে বুধবার সন্ধ্যায় নাটকটির মঞ্চায়ন অনুষ্ঠানে শেরপুর জেলা পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বিপিএমের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নাটকটি উপভোগ করেন বাংলাদেশ পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বিপিএম।

‘সূর্যদীর গল্প’ নাটকটি উপভোগ করছেন অতিথিরা। ছবি: শেরপুর জেলা পুলিশ

মঞ্চায়ন শেষে প্রধান অতিথি বলেন, ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত নাটকটি দেখলাম। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আফছার নিজের জীবনের বিনিময়ে প্রায় অর্ধশত মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন।’

এই যে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, এটা এমনি এমনি সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, এর পেছনে যে মানুষটি দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করেছিলেন, বাঙালি জাতিকে মুক্তির সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি আরও বলেন, ‘আমি এই অগ্নিঝরা মার্চ মাসে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। আমি শ্রদ্ধা জানাই লক্ষ শহীদকে, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে, অজস্র মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। আমি শ্রদ্ধা জানাই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিহত সব শহীদ সদস্য ও জাতীয় চার নেতাকে, যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে; তাঁদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।’

মঞ্চায়ন শেষ হওয়ার পর বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধান অতিথি বাংলাদেশ পুলিশের ময়মনসিংহ রঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বিপিএম। ছবি: শেরপুর জেলা পুলিশ

তিনি বলেন, ‘এই স্বাধীনতার মাসেই সূর্যদীর গল্প; যেখানে অজস্র কান্না, অজস্র হাহাকার লুকিয়ে আছে। ভেতর থেকে যদি এই আবেগটা কাজ না করে, তাহলে এটি তুলে ধরা সম্ভব নয়। এটি তুলে ধরার জন্য আমি পুলিশ সুপার শেরপুর কামরুজ্জামানের প্রতি আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে মঞ্চায়নে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, সবাইকে আমার ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নাটকটি উপভোগ করেন আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, কমান্ড্যান্ট (পুলিশ সুপার) ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার, শেরপুর; সানজিদা হক মৌ, সভানেত্রী, পুনাক, শেরপুর; ছানুয়ার হোসেন ছানু, সাধারণ সম্পাদক, জেলা আওয়ামী লীগ, শেরপুর; গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া, মেয়র, শেরপুর পৌরসভা; বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম হিরো; জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাংবাদিক এবং সর্বস্তরের জনসাধারণ নাটকটির মঞ্চায়ন উপভোগ করেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন অনুষ্ঠানের সভাপতি শেরপুর জেলা পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বিপিএম। ছবি: শেরপুর জেলা পুলিশ

পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বিপিএম বলেন, ‘সূ্র্যদীর গল্প নাটকে আফছারের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কাহিনি আমরা সারা দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চাই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় আমরা তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর। আপনাদের এই বীরত্বের কথা ও দুঃসাহসী ইতিহাসগুলোকে ধারণ ও লালন করি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা এগুলো সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা জীবিত আছেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতেই এই আয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে রেখে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমরা বাংলাদেশ পুলিশ সর্বদা কাজ করে যাচ্ছি।’

পরিশেষে সব কলাকুশলীকে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর সকাল আটটায় স্থানীয় রাজাকারদের নির্দেশে শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদী গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন গ্রামবাসী কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিস্তানি বাহিনীরা ছুড়তে থাকে এলোপাতাড়ি গুলি এবং পুড়িয়ে ছাই করে দেয় প্রায় দুই শ ঘরবাড়ি।

সূর্যদীর গল্প উপভোগ করছেন অতিথিরা। ছবি: শেরপুর জেলা পুলিশ

ওই সময় গ্রামের একটি ধানখেতে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আফছার উদ্দিন দূর থেকেই ফাঁকা গুলি করতে থাকেন। গুলির আওয়াজ পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী লাইনে দাঁড় করানো লোকদের ফেলে রেখে ছুটে যায় তাঁর সন্ধানে। পরে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধা আফছার উদ্দিন ও সূর্যদী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামানকে একটি ধানখেতে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা আফছারের আত্মত্যাগের বিনিময়ে প্রায় পঞ্চাশজন নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণে বেঁচে যান। পাকিস্তানি বাহিনীর ওই সহিংসতায় শহীদ হন গ্রামের মোট ৪৯ জন নিরীহ মানুষ।
অতিথিদের সঙ্গে নাটকের সঙ্গে জড়িত কলাকুশলীরা। ছবি: শেরপুর জেলা পুলিশ

সেই ঘটনা অবলম্বনে ‘সূর্যদীর গল্প’ নাটকটি পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান বিপিএমের গবেষণা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে রচনা করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইমরান আহম্মেদ পিপিএম এবং শেরপুর সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক শিবশংকর কারুয়া। নাটকটি জেলা পুলিশের আয়োজনে দ্বিতীয়বার পুলিশ লাইনস মাল্টিপারপাস শেডে সফল মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হলো।