দেশের নামকরা একটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ (ছদ্মনাম)। প্রেমঘটিত কারণ, পরীক্ষায় খারাপ ফলসহ বিভিন্ন কারণে মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন ফয়সাল। পুরো এলোমেলো হয়ে যায় তাঁর জীবন। মাদকের টাকা জোগাড়ে মাদক কারবারেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। ফলাফল, কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয় তাঁকে।
ফয়সালের মতো মাদকাসক্ত আরও অনেক তরুণ চিকিৎসা নিয়েছেন, নিচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের উদ্যোগে নির্মিত ওয়েসিস মাদক নিরাময়, পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্রে। মাদকের অন্ধকার জগতে পা বাড়ানো মানুষদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে আড়াই বছর আগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার প্রায় আড়াই বছরে এমন অনেক গল্পের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ‘ওয়েসিস’। খবর ঢাকা টাইমস।
‘ওয়েসিস’-এর বাংলা হলো মরূদ্যান। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘ওয়েসিস’। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক পরিবেশে উন্নত ব্যবস্থাপনায় দেশের সবচেয়ে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র এটি। এখানকার চিকিৎসা পদ্ধতি, পরিবেশ এবং সবার আন্তরিকতা খুবই চমৎকার।
বর্তমানে ওয়েসিসের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বিপিএম(বার), পিপিএম (বার)। প্রতিষ্ঠানটি থেকে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক মাদকাসক্ত নারী-পুরুষ চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।
ওয়েসিসে চিকিৎসা নেওয়া ফয়সালের পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁরা যখন বুঝতে পারেন, ফয়সাল ভয়াবহভাবে মাদকে জড়িয়ে পড়েছে, তখন একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পর সেখান থেকে ফিরে তিনি পুনরায় মাদক সেবন ও বিক্রিতে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে একাধিক নিরাময় কেন্দ্রে তাঁকে চিকিৎসা করানো হলেও সুফল পাননি তাঁরা। সর্বশেষ তাঁকে ওয়েসিসে ভর্তি করানো হয়। ফয়সাল বলেন, ‘এবার তিনি অতীতের করে আসা সব ভুল বুঝতে পারছেন। এখানে ভর্তি হওয়ার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছেন, হাদিসের বই পড়েন, জিম করেন, বিকেলে ছাদে হাঁটাহাটি করেন। তা ছাড়া ওয়েসিসের খাবারের মানও উন্নত। ফলে তার কাছে মনে হয়, তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই বসবাস করছেন।’
প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকেই এখানে কাজ করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোর্তজা হাসান। তিনি বলেন, ‘এখানে যেসব রোগী আসেন, তাঁদের বেশির ভাগ হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত। এ ক্ষেত্রে প্রকারভেদে তাঁদের বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে ইয়াবা আসক্ত রোগী বেশি জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘ইয়াবা বহন করা সহজ। এ কারণে এই নেশায় বেশি মানুষ আসক্ত হয়। এরপরেই গাঁজাসেবীর সংখ্যা। এটার কারণ খরচ কম, ইয়াবার মতো বহনও সহজ।’
বর্তমানে ওয়েসিসের সক্ষমতা কতটুকু জানতে চাইলে মোর্তজা হাসান বলেন, ‘অন্যান্য হাসপাতাল বা নিরাময় কেন্দ্র যেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবে, আমরা তার থেকে আরও বেশি কিছু দিতে পারব। এ ক্ষেত্রে আমরা দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওয়েসিসকে তুলনা করতে পারি। কারণ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে সাইকিয়াট্রিস্টরা অন-কলে বা সপ্তাহে একবার রোগী দেখেন। কিন্তু আমরা প্রতিদিন দেখি। যদি রাতে না-ও থাকি, অন্যান্য চিকিৎসক বিষয়টি জানালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অন্য প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিয়ে আসা অনেকে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁরাই বলেছেন, সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আর এখানকার চিকিৎসা পুরোপুরি ব্যতিক্রম।’
ওয়েসিসের সাততলা ভবনের নিচতলায় নিরাপত্তাকর্মীদের কক্ষ। যেখানে পুলিশ সদস্যরা শিফটে ডিউটি করেন। এর পাশেই আউটডোরে রোগী দেখা হয়। পাশেই নিজস্ব রান্নাঘর। ভবনের প্রথম তলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আবাসিক ব্যবস্থায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। পাশাপাশি ভবনটিতে রয়েছে সর্বাধুনিক প্যাথলজি ল্যাব। এসি ফ্লোর, জেনারেল বেডের ওয়ার্ড, ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা, বিশেষ কেবিন ও ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা। শুধু খেলাধুলাই নয়, পড়ালেখার জন্য লাইব্রেরির সুব্যবস্থাও আছে। এ ছাড়া রয়েছে নার্সিং স্টেশন। এর ঠিক ওপরেই গড়ে তোলা হয়েছে সুসজ্জিত বাগান। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগীদের জন্য ইয়োগা ও মেডিটেশন করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বাগানে।
ছাদবাগানের পাশে ব্যায়ামাগার। ওয়েসিসে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, ইয়োগা এক্সপার্ট এবং অভিজ্ঞ অ্যাডিকশন কাউন্সেলরদের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা।
প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা পুলিশের পরিদর্শক সুশান্ত নারায়ণ দে বলেন, ‘পত্রপত্রিকার মাধ্যমে আমরা দেখি, মাদক নিরাময়ের নামে রোগীদের আটকে রাখা, নির্যাতন করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের প্রধান লক্ষ্য রোগীদের সেবা দেওয়া। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী একজন রোগীর যা যা দরকার, সবই এখানে আছে। হাবিবুর রহমান স্যার সরাসরি এটা তদারক করেন। এখানে কোনো কিছুর ব্যত্যয় যাতে না হয়, সে ক্ষেত্রে তিনি খুবই কঠোর।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে বাইরের খাবারের অনুমোদন নেই। এখানে টাটকা খাবার রান্না করা হয়; যা রোগী ও স্টাফ মিলে প্রতিবেলায় প্রায় ৭০ জন।’
ওয়েসিসের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকাসক্ত সব রোগীই এখানে চিকিৎসা নিতে পারেন। যাঁরা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাঁদের সব সময় কাউন্সেলিং করা হয়। কেন মাদকে জড়ালেন, তাঁকে যেসব ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, সব ঠিকমতো কাজ করছে কি না- এসব বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়। চার মাস চিকিৎসা শেষে কেউ ফিরে গেলেই ওয়েসিসের কাজ শেষ হয়ে যায় না। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রতিনিয়ত রোগী ও তাঁর স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং তাঁরা ওয়েসিসে এলে তাঁদের বিনা মূল্যে ফলোআপ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। ফলোআপে সন্দেহ হলে ডোপটেস্ট করা হয়।
সূত্র বলছে, ওয়েসিসে একসঙ্গে ৪৬ জন পুরুষ ও ১৪ জন নারী মিলিয়ে মোট ৬০ জনকে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া বহির্বিভাগে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হয়। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমেও অনেকে সেবা নেন; যেখানে অভিভাবকেরা বেশি ফোন করেন। ওয়েসিসের বিশেষজ্ঞরা বিনা মূল্যে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। প্রতি মাসে দেড় শতাধিক মানুষ টেলিসেবা নিয়ে থাকেন। এ জন্য ফোন করতে হয় ০১৯৩০-৪০৪০৪০ এই নম্বরে।
ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) বলেন, ‘ওয়েসিসে চিকিৎসার মান ও পরিবেশ আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি অনেকে বিসিএস পরীক্ষারও জন্য পড়াশোনা করছেন। নারীদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমাদের কাছে যাঁরা সেবা নিতে এসেছেন, তাঁরা চিকিৎসা শেষে ফিরে যাওয়ার পরেও তাঁদের মনিটরিং করা হয়। ফোনে রোগী বা তাঁর স্বজনদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি সুস্থ আছেন কি না। যদি সমস্যা হয়, তাহলে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমরা পরামর্শ দিই; তিনি যাতে সুস্থ থাকেন। আমাদের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার পর একজন মাত্র রোগী পুনরায় নেশায় আসক্ত হয়েছিলেন। পরে তাঁকে ভর্তি না করে পরামর্শমূলক চিকিৎসায় তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। এখন নিজেই আমাদের সঙ্গে বিনা পয়সায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে চান।’
প্রতিষ্ঠান চালাতে ভর্তুকি দেওয়া হয় জানিয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার এই সময়ে যতটুকু কাজ আমরা করেছি, সবই সাক্সসেসফুলি হয়েছে। এটাকে সমাজের পজিটিভ দিক হিসেবে মনে করি যে পুলিশ আইনের প্রয়োগ না করেও এমন কাজে সফল হচ্ছে।’
ওয়েসিসের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বলেন, বড় পরিসরে করার জন্য মানিকগঞ্জে একটি জায়গা নেওয়া হয়েছে। সেখানে রিসোর্ট টাইপের নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। সেখানে গেলে মনে হবে, মানুষ ঘুরতে এলে যেমন বিনোদনের জন্য আসে, সেখানকার পরিবেশও তেমনই থাকবে। খেলার মাঠ, উন্মুক্ত জায়গা থাকবে। পাশে কালীগঙ্গা নদীতে নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। সেখানকার যে চিকিৎসা পদ্ধতি থাকবে, তা সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের। আমরা মনে করি, মাদক নিরাময়ের ক্ষেত্রে এটি বড় ভূমিকা রাখবে।’