‘চিরঞ্জীব মুজিব’ শীর্ষক চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার)। ছবি: পুলিশ নিউজ

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে মানুষটির হাত ধরে বাংলাদেশ পুলিশে সংস্কার এসেছে, যোগ হয়েছে নতুন নতুন বিষয়, আধুনিক হয়ে উঠেছে পুলিশ বাহিনী, তিনি বর্তমান ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার)। তাঁর নতুন নতুন উদ্যোগের কারণে পুলিশ বাহিনী এখন হয়ে উঠেছে জনবান্ধব।

বেনজীর আহমেদ তাঁর ৩৪ বছরের বর্ণাঢ্য পেশাগত জীবনে পাড়ি দিয়েছেন অনেক বন্ধুর পথ। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার বেনজীর আহমেদকে দেশের ৩০তম পুলিশপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়। এরপর থেকে তাঁর নানা পদক্ষেপের কারণে ‘জনমুখী পুলিশি সেবা’ পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। থানা থেকে বের করে পুলিশকে মানুষের দোরগোড়ায় নিতে একের পর এক সাহসী ও সময়োপযোগী নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবেলায় মানুষের পাশে থেকে সেবা দেওয়া, জঙ্গি ও মাদক নির্মূলে প্রতিনিয়ত অভিযানসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে পুলিশ।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেনজীর আহমেদকে র্যা বের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি দায়িত্ব বুঝে নিয়ে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে ভূমিকা পালন করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ান তিনি। হলি আর্টিজান হামলায় প্রাথমিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নির্মূলে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানও বেগবান রেখেছেন। সুন্দরবনের জলদস্যুতার অবসান ঘটিয়ে একটি স্বস্তির উপকূলীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে তার সাফল্যের মুকুটে আরও একটি উজ্জ্বল পালক।

বেনজীর আহমেদ ১৯৬৩ সালের ১ অক্টোবর গোপালগঞ্জের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ এবং এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্ট্যাডিজ, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা চার্লস স্ট্রার্ট ইউনিভার্সিটি ও সিঙ্গাপুরের বিশ্বব্যাংক আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পড়াশোনা করেন তিনি। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

সপ্তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ ১৯৮৮ সালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। র্যা বের ডিজি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ছয় বছরের বেশি। তার আগে তিনি প্রায় সাড়ে চার বছর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ছিলেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে পুলিশের স্লোগান ছিল ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’। পুলিশের এই স্লোগানের যথার্থতার প্রমাণ মেলে করোনা দুর্যোগকালে তাদের মানবিক ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে। বেনজীর আহমেদ আইজিপির দায়িত্ব যখন পান, তখন দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব চলছে। তাঁর নেতৃত্বেই মানবিক পুলিশ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে পুলিশ। করোনায় মৃত ব্যক্তিকে যখন আপনজনরা ছেড়ে চলে গেছে, তখন পুলিশ গিয়ে তাদের দাফন ও সৎকার করছে।

বদলে যাওয়া কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল

পুলিশ সদস্যদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢেলে সাজানো হয়েছে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল। অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বদলে গেছে হাসপাতালটির চিত্র। বেড়েছে সেবার মান ও পরিধি। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ২০২০ সাল পর্যন্ত কোনো নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউ ছিল না। বর্তমান পুলিশপ্রধানের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করা হয়েছে ১৫ শয্যার আইসিইউ এবং ১৪ শয্যার এসডিইউ। এখন এই হাসপাতালে ১৫০ জনের মতো চিকিৎসক রয়েছেন।
হাসপাতালটির দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলছেন, চা‌হিদার সঙ্গে তাল মি‌লি‌য়ে বেড়েছে চিকিৎসা ও সেবার মান। পুলিশপ্রধানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় করোনা আক্রান্তদের সুচিকিৎসায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বাহিনীর সদস্যদের মর্যাদাবৃদ্ধিতে উদ্যোগ
সম্প্রতিক পুলিশের যেসব সদস্য চাকরিজীবন শেষ করছেন, তাদের সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানানোর রেওয়াজ শুরু হয়েছে আইজিপি বেনজীর আহমেদের হাত ধরেই। বিভিন্ন উপহারের পাশাপাশি পুলিশের গাড়িতে করে তাদের কর্মস্থল থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সদস্যরা বলছেন, বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আইজিপির যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা, সেখান থেকেই এই ধরনের কাজ সম্ভব হচ্ছে।

এছাড়া সম্প্রতি আইজিপির বিশেষ উদ্যোগে পুলিশ সদস্যদের কল্যাণে হ্রাসকৃত ভাড়ায় দূরপাল্লার বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

ঘরে বসে আরও সেবা
বেনজীর আহমেদের নেতৃত্বে পুলিশকে একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীতে রূপান্তর করতে কাজ করছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স। পুলিশের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সারা দেশকে ছয় হাজার ৯১২টি বিটে ভাগ করে প্রতি বিটে একজন কর্মকর্তাকে পদায়নের মাধ্যমে ‘বিট পুলিশিং‘ কার্যক্রম চালু করেন আইজিপি। এতে থানায় না গিয়ে ঘরে বসে পুলিশের সেবা পাচ্ছে মানুষ, কমেছে ভোগান্তি। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও বেড়েছে।

নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা দূর
আইজিপির নির্দেশে পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা দূর করতে যুগোপযোগী পরিবর্তন আনা হয়েছে। পুলিশের পদোন্নতি পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তও তাঁর। তিনি প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের আধুনিকায়ন, যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন, মডিউল তৈরি ইত্যাদি কার্যক্রম গ্রহণ করেন। কনস্টেবল থেকে অতিরিক্ত আইজি পর্যন্ত সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জন্য বছরে অন্তত একবারের জন্য হলেও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের সব সদস্যের জন্য একই সিরিয়ালের (০১৩২) মোবাইল ফোন নম্বর চালু করেছেন।

বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘সবাই বলে যে করাপশন বন্ধ করতে হলে কয়েকটি বেসিক জায়গায় কাজ করতে হবে। নিয়োগ, পদোন্নতি এবং পদায়ন। আমরা কিন্তু কনস্টেবল ও সাব ইন্সপেক্টর নিয়োগ পূর্ণাঙ্গ ওভারহেলিং করেছি। সম্প্রতি সাড়ে ৩ হাজার কনস্টেবল রিক্রুট করেছি, এটি সাড়া ফেলেছে সারা দেশে। আমরা কোথাও বলিনি, আমরা ট্রান্সপারেন্সির মাধ্যমে নিয়োগ করেছি। বরং মেইনস্ট্রিম মিডিয়া বলছে, কত স্বচ্ছ হয়েছে এবারের রিক্রুটমেন্ট। নিয়োগ প্রক্রিয়া আমরা এমনভাবে তৈরি করেছি, যেটি ট্রান্সপারেন্ট হতে বাধ্য। পদায়নের ক্ষেত্রেও আমরা চেষ্টা করছি শতভাগ স্বচ্ছতা। এগুলো পলিসির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করছি।’

এ ছাড়া জনগণের পুলিশ হতে হলে পুলিশকে সব ধরনের দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে পুলিশের অবস্থান এখন শূন্য সহনশীল। এটিও আইজিপির নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে।

হ্যান্ডস ফ্রি পুলিশিং
পুলিশপ্রধানের পদক্ষেপের কারণে ‘জনমুখী পুলিশি সেবা’পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। উন্নত পুলিশি সেবা দিতে হ্যান্ডস ফ্রি পুলিশিং চালু করতে মাঠপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের টেকটিক্যাল বেল্ট দেওয়া হয়েছে। ছয় চেম্বারের আধুনিক এই ট্যাকটিক্যাল বেল্টে থাকছে পিস্তল, হ্যান্ডকাফ, অতিরিক্ত ম্যাগাজিন, এক্সপেন্ডেবেল ব্যাটন, পানির পটসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের হাত থাকছে সম্পূর্ণ খালি। এতে বিপদগ্রস্ত মানুষের যেকোনো প্রয়োজনে দ্রুত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারছে পুলিশ। আবার অপরাধীকে দ্রুত ঘায়েল করতে ট্যাকটিক্যাল বেল্টে থাকা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করা যাচ্ছে অনায়াসে।

নারীর জন্য সাইবার নিরাপত্তা
পুলিশপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর বেনজীর আহমেদ নারীদের নিরাপত্তায় কাজ করেছেন বিভিন্ন উদ্যোগের সফল কার্যকরের মাধ্যমে। নারীরা যাতে সাইবার বুলিংয়ের শিকার না হন, তাদের জন্য নিরাপদ সাইবার স্পেস নিশ্চিত করতে চালু করেছেন ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ফেসবুক পেজ। প্রতিটি থানায় চালু করা হয়েছে নারী, শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী সার্ভিস ডেস্ক।

অত্যাধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র
পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে গড়ে তোলা হয়েছে অত্যাধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র- ওয়েসিস। উন্নত ব্যবস্থাপনায় দেশের সবচেয়ে অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র হবে এটি। সম্পূর্ণ অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে। সবার জন্য উন্মুক্ত। আইজিপি বেনজীর আহমেদের প্রচেষ্টায় প্রকল্পটির তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ও একদল দক্ষ কর্মীবাহিনী।

ভূমিহীনদের জন্য কবরস্থান-মসজি;
লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুরে-রামগতি সড়কের দুই পাশে বসবাসকারী নদীভাঙনের শিকার ভূমিহীন প্রায় ২ হাজার মানুষের জন্য কবরস্থান ও মসজিদের ফলক উন্মোচন করেন পুলিশপ্রধান। এ সময় মসজিদ ও কবরস্থানের জন্য প্রায় ৩০ শতক জমির দলিল হস্তান্তর করেন তিনি। দুই হাজার ভূমিহীন মানুষের জন্য কবরস্থান গড়ে দেওয়ার মূল স্থপতি আইজপি বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী পুনাক সভানেত্রী জীশান মীর্জা।

এগিয়ে যপাচ্ছে ক্রীড়াও
আইজিপির হাত ধরে থিতিয়ে যাওয়া দাবাও এসেছে মূলধারায়। পেয়েছেন দক্ষিণ এশীয় দাবা কাউন্সিলে প্রথম নির্বাচিত সভাপতি হওয়ার সম্মান। অবহেলিত বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন প্রাণ পেয়েছে তার উদ্যমী স্পর্শে। দাবার পৃষ্ঠপোষকতায় যুক্ত করেছেন দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীকেও। পুলিশের বর্তমান এই প্রধানের হাত ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের ‘দাবা টুর্নামেন্ট’।

পুলিশের সর্বোচ্চ পদক লাভ
বেনজীর আহমেদ চাকরিজীবনে সর্বোচ্চ সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম)। ২০২০ সালে ষষ্ঠবারের মতো বিপিএম (সাহসিকতা) অর্জনের রেকর্ড গড়েন তিনি। এর আগে ২০১১, ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ ও ২০১৯ সালে এই পদক তার সাফল্যের মুকুটে যোগ হয়।