বার্ষিক পুলিশ প্যারেড অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের পুলিশ জনগণের পুলিশ হিসেবে সেবা দিচ্ছে। অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই আপনারা এই সেবা দিয়ে যাবেন। আমরা চাই, আমাদের পুলিশ বাহিনী জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী হিসেবেই মানুষের পাশে থাকবে।’

রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ৩ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) বাংলাদেশ পুলিশের বার্ষিক প্যারেড অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা, জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদ এবং মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অবদানের কথা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পুলিশ সপ্তাহের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরই দেশ গঠনে হাত দেন। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক করার কাজ শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি প্রথম নারী পুলিশ নিয়োগ দেন। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি; কিন্তু তিনি পারেননি।

বিপিএম-পিপিএম পদকপ্রাপ্তদের পদক পরিয়ে দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আমাদের পুলিশ বাহিনীর মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ রেশন পেত। তাদের থাকার জায়গা ছিল না। হাসপাতাল ছিল না। আমরা সেগুলো গড়ে তুলি। আমি একবার এখানে প্যারেড করতে পারিনি। আমরা এই প্যারেড গ্রাউন্ড গড়ে তুলি। পুলিশের বাজেট বৃদ্ধি করেছি। যতটা পুলিশের দরকার, সব রকম ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। সবার রেশনের ব্যবস্থা করেছি। অবসরপ্রাপ্তদেরও রেশনের ব্যবস্থা করেছি। ২০০০ সালে পুলিশ স্টাফ কলেজ স্থাপন করি। এখন তা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হয়েছে। অনেক দেশ থেকে আমাদের পুলিশ স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ নিতে আসছে।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আমরা পুলিশের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করি। ১৯৯৮ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথম জেলা পুলিশ সুপার পদে একজন নারীকে নিয়োগ করি। পুলিশের ঝুঁকি ভাতা চালু করি। তিনি বলেন, আমরা ৫ কোটি সিড মানি প্রদান করে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করি। ২৫টি থানা, ৮৬টি তদন্ত কেন্দ্র, ৫৮টি হাইওয়ে ফাঁড়ি, ১৫০টি পুলিশ ক্যাম্প এবং ১০টি ফাঁড়ি স্থাপন করি। ৮০৩ জন এসআই, ৫০৭ জন সার্জেন্ট এবং ১৪ হাজার ৬৮০ জন কনস্টেবল নিয়োগ করি। কমিউনিটি পুলিশ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে আত্মনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে আমাদের সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশকে আধুনিক ও জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে আমরা বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। পুলিশের আধুনিকায়নে আমরা ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। বাংলাদেশ পুলিশে নতুন পদ সৃষ্টির মাধ্যমে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতিপ্রাপ্তির জটিলতা নিরসন করা হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের মতো বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করেছি। এসব বিশেষ ইউনিটের দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় নিরাপত্তা নিশ্চিতে আর্মড পুলিশের দুটি ও র‌্যাবের একটি ব্যাটালিয়ন গঠন করে কক্সবাজারে মোতায়েন করা হয়েছে। পার্বত্য জেলাগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তিনটি আর্মড পুলিশ মাউন্টেন ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খোলা জিপে করে প্যারেড পরিদর্শন করেন। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে ইতোমধ্যে পুলিশে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) গঠন করেছি। বাংলাদেশ পুলিশে ইতোমধ্যে ডিএনএ ল্যাব, আধুনিক ফরেনসিক ল্যাব, অটোমেটেড ফিঙ্গার প্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম এবং আধুনিক রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রতিটি বিভাগীয় সদর দপ্তরে এ ধরনের ল্যাব স্থাপন করা হবে। তিনি বলেন, সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় আমরা সিআইডিতে একটি সাইবার পুলিশ সেন্টার স্থাপন করেছি। এ ছাড়া ডিএমপির সিটিটিসিসহ পুলিশের অন্যান্য ইউনিটও সাইবার অপরাধ দমনে কাজ করছে। অচিরেই আমরা বাংলাদেশ পুলিশে একটি পূর্ণাঙ্গ সাইবার পুলিশ ইউনিট স্থাপন করব এবং জেলা পর্যন্ত এ ইউনিটের শাখা বিস্তৃত করা হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে ইতোমধ্যে কমিউনিটি ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে সহজেই পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণও আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা ভোগ করছে। তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসাসেবার জন্য কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ বিভাগীয় পর্যায়ে পুলিশ হাসপাতালের উন্নয়নে আমরা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ঢাকা বিভাগে একটি বিভাগীয় হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অন্যান্য বিভাগীয় শহরেও পুলিশ হাসপাতাল হবে। পুলিশ বাহিনীকে ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হবে উল্লেখ করে এ সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানান, পুলিশের জন্য রাশিয়া থেকে দুটি হেলিকপ্টার কেনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ এভিয়েশন ইউনিট গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভালো সময় এলে আমরা আরও ব্যবস্থা নেব। তিনি বলেন, পুলিশ সব সময় মানুষের পাশে থাকে। প্রাকৃতিক, এমনকি মানবৃসষ্ট দুর্যোগেও পুলিশ নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের পাশে থেকেছে। ২০১৩-১৪ সালে অগ্নিসন্ত্রাসের সময় পুলিশও আক্রান্ত হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা জীবনবাজি রেখে এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড রুখে দিয়েছেন। এ ধরনের জঘন্য ঘটনা বাংলাদেশে আর যেন না ঘটে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গি-সন্ত্রাসী বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। হোলি আর্টিজানের ঘটনার সময় পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে গিয়েছিলেন। দুজন জীবন দিয়েছেন। পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই, জঙ্গি-সন্ত্রাস, মাদক, মানব পাচারসহ সব অপরাধ প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশ বাহিনী, বিশেষ করে মহিলা কন্টিনজেন্টের কাজের কারণে বিশ্বজুড়ে সুনাম বাড়ছে। তিনি বলেন, ৯৯৯ সেবার মাধ্যমে পুলিশ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে। পুলিশ নারী, শিশু, বয়স্কদের জন্য প্রতিটি থানায় ডেস্ক স্থাপন করেছে। পুলিশের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল এটি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালে আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। কিন্তু করোনা, যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় বৈশ্বিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। তিনি বলেন, কোথাও যেন এক ইঞ্চি জমি অনাবাদি না থাকে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা। এই ধাক্কা যেন বাংলাদেশে না আসে। আসুন, আমরা পুলিশ বাহিনীকে স্মার্ট পুলিশ বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলি।

এর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশপ্রেম ও সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের বিপিএম (বাংলাদেশ পুলিশ পদক) ও পিপিএম (রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক) পদকপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের পদক পরিয়ে দেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় সালাম দেওয়া হয়। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ

এবার ১১৫ জন পুলিশ সদস্য বিপিএম ও পিপিএম পদক পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ১ জানুয়ারি পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০২২ সালের অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এবার ১৫ জন পুলিশ সদস্য ‘বিপিএম’ এবং ২৫ জন পিপিএম পেয়েছেন। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামূলক আচরণের মাধ্যমে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য ২৫ জন পুলিশ সদস্য ‘বিপিএম-সেবা’ এবং ৫০ জন ‘পিপিএম-সেবা’ পদক পেয়েছেন।

এর আগে সকাল ১০টায় রাষ্ট্রীয় সালামের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশ পুলিশের বার্ষিক প্যারেড। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সালাম দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের ব্যান্ড দল পরিবেশন করে জাতীয় সংগীত।

পরে কুচকাওয়াজ অধিনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্যারেড পরিদর্শনের অনুরোধ জানান। এরপর একটি খোলা জিপে করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্যারেড পরিদর্শন করেন। পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হয়।