‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস-২০২২’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: বাসস

‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’কে একটি মহৎ কাজ অভিহিত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জাতীয় পতাকার মান সমুন্নত রেখে বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছেন। খবর বাসসের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রোববার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস-২০২২’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এই আহ্বান জানান। গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বছরের শান্তিরক্ষী দিবসের থিম ‘জনগণের শান্তি অগ্রগতি: অংশীদারিত্বের শক্তি’-এর মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করার অঙ্গীকার করেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশকে বিশ্বে একটি শক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন এবং এর পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখবেন।’ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত শান্তিরক্ষীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘পেশাদারিত্ব ও সততা বজায় রেখে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব স্ব স্ব পালন করতে হবে। নিজেদের সুরক্ষিত রেখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে কাজ করবেন। কারণ, বিশ্ব শান্তি প্রচার করা একটি মহৎ কাজ।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর তরুণ সদস্যগণ একুশ শতকের বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম। তিনি বলেন, সব সময় মনে রাখবেন, যেকোনো দায়িত্ব পালনে আত্মবিশ্বাসটা হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। কাজেই সকলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করবেন। তাহলেই আপনারা সফল হবেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রয়োজনে আরও শান্তিরক্ষী পাঠাতে প্রস্তুত। বিশ্ব করোনাভাইরাসের মতো মহামারি অতিক্রম করতে করতেই আবার একটি যুদ্ধের দামামা (রাশিয়া-ইউক্রেন) বেজে উঠেছে; যা আজকে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, আমরা কোনো যুদ্ধ বা সংঘাত চাই না, শান্তি চাই। সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, সেটাই আমাদের কাম্য। বিশ্ববাসীর পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আপনাদের এই ভূমিকা চিরকাল স্মরণ রাখবে।

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’বলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে গেছেন, তা এখনো অনুসরণ করা হচ্ছে বলে জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি করার দিকে মনোনিবেশ করেছি। বাংলাদেশ সব সময় চায়, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। আমরা যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। সংঘাত না, আমরা উন্নতি চাই।’

সমসাময়িক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার ও অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় এবং অরাষ্ট্রীয় অপশক্তিগুলো নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনগুলোতে শান্তিরক্ষীদের বহুমাত্রিক ও জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।’

জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা অপারেশনে এই নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শান্তিরক্ষীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামাদি দিয়ে প্রস্তুত করে তোলা হচ্ছে বলেও জানান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর তরুণ সদস্যগণ একুশ শতকের বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম।’

জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ মিশনে কার্যকর অংশগ্রহণ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অবস্থানকে সুসংহত করেছে। একই সঙ্গে সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দেশের পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’

শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা দেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন বলেও জানান সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধীনে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সদা প্রস্তুত। এ মুহূর্তে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ১২১টি দেশের ৭৫ হাজার ৫১৬ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮২৫ জন শান্তিরক্ষী রয়েছেন, যা বিশ্বে নিয়োজিত সর্বমোট শান্তিরক্ষীর ৯ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের ৫১৯ জন নারী শান্তিরক্ষী বিশ্ব শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন। আমি জেনে আনন্দিত যে, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী তাদের মহিলা শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করছে।’

বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের নারীদের ভূমিকাও তুলে ধরেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘শান্তিরক্ষা মিশনে গিয়ে একদিকে শান্তিরক্ষীরা এবং মেয়েরা যে দায়িত্ব পালন করছেন, সেটার সবাই ভূয়সী প্রশংসা করছেন। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলও সব সময় প্রশংসা করেন। আমি সত্যিই খুব গর্বিত যে, আমাদের মেয়েরাও সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। শান্তি রক্ষা মিশনে সবাই, ছেলে-মেয়ে আমি কোনো বিভেদ করি না। সবাই স্ব স্ব দায়িত্ব অত্যন্ত ভালোভাবে পালন করছেন।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত দক্ষিণ সুদান, লেবানন, সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক এবং কঙ্গোতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি কন্টিনজেন্টের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি ইউএনপিসকিপিং জার্নালের একটি ভলিউমের মোড়কও উন্মোচন করেন।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী আনিসুল হক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল বিরামে ডিওপ এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি জিওন লুইস অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।

আনিসুল হক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শান্তিরক্ষা মিশনে দুই শহীদের পরিবারকে এবং সাহসিকতার জন্য একজনকেসহ ১৪ জন আহত শান্তিরক্ষীকে পদক প্রদান করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গকারী শান্তিরক্ষীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ৩৪ বছরের যাত্রার ওপর একটি ছোট ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রদর্শিত হয়।