ভুল বিকাশ নম্বরে চলে যাওয়া টাকা প্রকৃত মালিকের কাছে হস্তান্তর করছে পুলিশ। ছবি: সংগৃহীত

বিকাশে ভুল নম্বরে চলে যাওয়া টাকা উদ্ধার, হারানো মোবাইল উদ্ধার, নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের সহায়তাসহ বিভিন্ন সেবা সাধারণ মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিচ্ছে খুলনা সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল। কাঙ্ক্ষিত সেবা পেয়ে পুলিশের প্রতি কৃতজ্ঞ সেবাগ্রহীতারা। খবর ঢাকা পোস্টের।

পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খুলনা রেঞ্জের আওতাধীন খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলায় সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল কাজ করছে। ১০টি ইউনিটে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন ৯৪ জন সদস্য। ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর থেকে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল চালু হওয়ার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০টি ইউনিটে মোট অভিযোগ এসেছে ১ হাজার ৬৯টি। এগুলোর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৭৪টি অভিযোগ আর মুলতবি অভিযোগের সংখ্যা ৭৬১টি। এ ছাড়া মামলা তদন্তাধীন রয়েছে ৩০টি। থানা-পুলিশকে ২৪৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সহায়তা করা হয়েছে।

খুলনার এক বাসিন্দা বলেন, ৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে আমার বোন পাঠিয়েছিল। কিন্তু একটি ডিজিট ভুল করার কারণে টাকাটা অন্য জায়গায় চলে যায়। যোগাযোগ করলে তাঁরা বলেছিল টাকা পাঠাবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ফোন বন্ধ করে রাখে। পরে বটিয়াঘাটা থানায় আমি একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। সেই জিডি বটিয়াঘাটা থানা-পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়ের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেলে পাঠায়। এসপি স্যারের নির্দেশে সাইবার ক্রাইম ব্রাঞ্চ সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে। কাজ শুরুর আট দিন পর কুড়িগ্রাম থেকে টাকা উদ্ধার করে সাইবার ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে আমাকে ফোন করে বলে, আপনার টাকা পাওয়া গেছে, আপনি এসে নিয়ে যান। উদ্ধার করা টাকা তারা আমার হাতে তুলে দেয়।

ঝালকাঠি জেলার এক বাসিন্দা বলেন, আমার ছেলে খুলনার রূপসা এলাকায় আসার পর নিখোঁজ হয়। এ বিষয়ে আমি অভিযোগ দিলে পুলিশ সুপারের নির্দেশনায় আমার ছেলেকে খুঁজে বের করে আমার কাছে ফেরত দেয়।

আমি এর আগে পুলিশকে ভয় পেয়েছি, আসতে চাইনি। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এসে আমার খুব ভালো লেগেছে।

খুলনার ফুলতলার একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, বাড়িতে থাকা অবস্থায় মোবাইল ফোনটি চুরি হয়ে যায়। এ বিষয়ে ফুলতলা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি। ফোনটি পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল থেকে আমাকে ফোন দেওয়া হয় যে আমার মোবাইলটি পাওয়া যাবে। তাঁরা আমার ফোনটি উদ্ধার করে দেন।

পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, সময়ের পরিক্রমায় তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে মানুষ এখন তথ্যপ্রযুক্তির সুফল ভোগ করছে। সুফলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে, যারা অপরাধ সংঘটিত করে, তারাও সেই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। ইনফরমেশন টেকনোলজি, সোশ্যাল মিডিয়া, ব্যাংকিং সিস্টেমসহ প্রতিটি জায়গায় তাদের বিচরণ আছে। সারা পৃথিবীতে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। ফলে যে গতানুগতিক অপরাধ আগে সংঘটিত হতো, এটা কমে আসছে অথবা স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। কিছু কিছু অপরাধ এখন শিফট হয়ে গেছে। যেমন সিঁদ কেটে চুরি এখন নেই বললেই চলে।

তিনি বলেন, এখন ইনফরমেশন টেকনোলজি সম্পর্কিত অপরাধের অভিযোগ প্রতিদিনই আসছে। খুলনা রেঞ্জের আওতাধীন ৬৪টি থানায় অভিযোগ আসে। আমরা মানুষকে সার্ভিস দিতে চাই এবং সাইবার অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে চাই। সেই আলোকে ২০২১ সালের শেষের দিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠাই। প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে জনবল, সাংগঠনিক কাঠামো, জব ডিসক্রিপশন, কার অধীনে থাকবে, কোন কোন র‌্যাংকে কারা থাকবে, সব কিছু দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে প্রস্তাবনা পাঠাই। আইজিপি মহোদয় এ ব্যাপারে সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেন। সে অনুযায়ী খুলনা বিভাগের ১০ জেলাতেই সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল গঠন করা হয়েছে। আমরা জনবল বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এখন ১০টি জেলাতে এই কার্যক্রম চলছে।

ডিআইজি মহিদ উদ্দিন বলেন, একসময় সাইবার সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ এলে আলাদা ইউনিট না থাকায় পুলিশের পক্ষ থেকে অনীহা দেখানো হতো। কিন্তু এখন কোথাও সাইবার সংক্রান্ত অভিযোগ এলে আর অনীহা দেখানো হয় না। এখানে আমাদের ইকুইপমেন্ট, ট্রেনিং, অফিসারদের অন্যান্য সক্ষমতা সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ১০টি ইউনিটকে দাঁড় করিয়েছি। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, আইজিপি মহোদয় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মাধ্যমে অন্যান্য রেঞ্জ বা মেট্রোপলিটনগুলোতেও এটি করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। আশা করি এই কার্যক্রমের সুফল খুলনা রেঞ্জের সবাই ভোগ করবে।

তিনি আরও বলেন, আগেই কিন্তু পুলিশের থানা ইউনিট বাদেও ডিবি ছিল। তারপর ট্রাফিক আছে, ডিএসবিসহ বিভিন্ন ইউনিট আছে। আর আমরা সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল গঠন করেছি সরাসরি পুলিশ সুপারের তত্ত্বাবধানে এবং তাঁর অফিসে। যাতে সাইবার রিলেটেড এক্সপার্ট এবং পুলিশ সুপার নিজে এটা মনিটরিং করতে পারেন। সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেলের ওপর প্রতি সপ্তাহে একটি মিটিং করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। একই সঙ্গে যেকোনো ভুলত্রুটি, মামলার তদন্তের অগ্রগতি এবং কী করা যায়, সেটি পর্যালোচনার জন্য পরামর্শ দেওয়া আছে। কাঠামোগতভাবে প্রতিটি জেলায় একটি করে সেল গঠন করা আছে। একটি ইউনিটে অফিসারসহ ১০ জন জনবল দেওয়া আছে।

ডিআইজি বলেন, আইটি রিলেটেড যেসব ক্রাইম হয়েছে, সেই সংক্রান্ত জিনিসপত্র ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মামলা হয়েছে, আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সাধারণ মানুষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। কাঙ্ক্ষিত সেবা পেয়ে অসংখ্য মানুষ আমাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে, টেক্সট পাঠিয়েছে।

খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহাবুব হাসান বলেন, সাইবার দুনিয়ায় আমাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে পেশাজীবীরা ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে সাইবার অপরাধ বেড়েছে। সাইবার অপরাধীরা পেশাগতভাবে খুবই দৃঢ় এবং তাঁদের পেশাগত জ্ঞান আছে। যার অনেকটাই আমরা সাধারণ মানুষ বুঝি না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনেকে প্রতারণার শিকার হন। এগুলো সামনে রেখে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি স্যারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল গঠন করা হয়। কাজ শুরুর পর ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। থানাগুলো এবং বিট থেকে অভিযোগগুলো সংগ্রহ করে মানুষকে সেবা প্রদান করছি। বিট পুলিশের সভার মাধ্যমে আমরা মানুষকে সচেতন করছি, সতর্ক হতে বলছি। কেউ প্রতারণার শিকার হলে সরাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলছি।

পুলিশ সুপার বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের তত্ত্বাবধানে ১০ জন জনবল রয়েছে। সাইবারের ক্ষেত্রে তাঁদের কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা ছোট সাফল্যগুলোকে সামনের পাথেয় হিসেবে বিবেচনা করি। বিশেষ করে হারানো মোবাইল ফোন উদ্ধার করা, বিকাশের মাধ্যমে অথবা অন্যান্য আর্থিক যে প্রতারণামূলক লেনদেন হয়, এগুলোর ক্ষেত্রে মানুষকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ ভালোভাবে নিয়েছি এবং আমরা সফলতার মুখ দেখেছি। আশা করি আগামী দিনগুলোতে মানুষ সাইবার জগৎ সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হবে।