প্রতিবারই হয়তো আপনি ভেবেছেন—এসব শুধুই ধাপ্পা; এমন পাগলামি পুতিন করতেই পারেন না। কিন্তু ঠিক সেটাই তিনি করেছেন।

আপনি ভেবেছেন—পুতিন কখনোই ক্রিমিয়া দখল করবেন না। তিনি সেটা করেছেন।

আপনি ভেবেছেন—ক্রিমিয়ায় যা-ই হোক, দনবাসে পুতিন যুদ্ধ শুরু করবেন না। তিনি সেটাই করেছেন।

ইউক্রেনে পুতিন সত্যি সত্যি সামরিক অভিযান শুরু করে দেবেন—এটাও বিশ্বাস হয়নি আপনার। কিন্তু সেটাও তিনি করেছেন।

মস্কোয় বিবিসির সাংবাদিক স্টিভ রোজেনবার্গ এ ধাঁধার উপসংহার টানতে চেয়েছিলেন এভাবে, ‘তিনি কখনোই এটা করবেন না’—এমন কথা অন্তত পুতিনের বেলায় বলা যাবে না।

কিন্তু তাতে আরও অস্বস্তিকর আরও আতঙ্কজাগানো একটি প্রশ্ন সামনে আসছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিশ্চয় পারমাণবিক বোমার বোতাম চেপে দেবেন না। তিনি সেটা করতে পারেন না। আসলেই তিনি সেটা করবেন?

এটা এখন আর কাল্পনিক কোনো প্রশ্ন নয়। বিবিসির বিশ্লেষণ, ভাষান্তর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর চতুর্থ দিনে এসে একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পাল্টায় সরাসরিই হুমকি দিয়ে বসেছেন রাশিয়ার নেতা। পারমাণবিক অস্ত্রের বহর তিনি তৈরি রাখার হুকুম দিয়েছেন সেনাবাহিনীকে। পশ্চিমারা এই ভয়টাই পাচ্ছিল।

পরিস্থিতি যেমনই হোক, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো কাজ পুতিন করতে পারেন কি না, তা বোঝার চেষ্টা করেছেন বিবিসির সাংবাদিক স্টিভ রোজেনবার্গ।

এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, পুতিনের মন বোঝার জন্য তাঁর কথাগুলো মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করা যেতে পারে।

পারমাণবিক অস্ত্রের বহরকে সতর্ক অবস্থায় রাখার নির্দেশ দেওয়ার সময় পুতিন ন্যাটোর নেতাদের ‘উগ্র কথাবার্তা’ এবং ‘বৈরী পদক্ষেপ’ নিয়ে নিজের আপত্তির কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, পশ্চিমারা যে নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর দিচ্ছে, তা ‘অন্যায়’।

তার আগে, গত বৃহস্পতিবার ভোরে টিভিতে ভাষণ দিয়ে পুতিন যখন ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ (আসলে পুরোদস্তুর আগ্রাসন) শুরুর ঘোষণা দিলেন, রক্ত হিম করা এক বার্তাও তিনি দিয়ে রেখেছিলেন।

‘কেউ যদি বাইরে থেকে এর মধ্যে নাক গলানোর কথা ভাবো, সে তুমি যে-ই হও, এমন এক পরিণতি তোমাকে ভোগ করতে হবে, যা ইতিহাসে কেউ কখনো করেনি।’

পুতিনের ওই কথায় পারমাণবিক অস্ত্রেরই প্রচ্ছন্ন হুমকি দেখতে পাচ্ছেন রাশিয়ার নোভায়া গেজেটা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভ, যিনি গত বছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনের ওই ভাষণে পুতিনকে ক্রেমলিনের কর্তা বলে মনে হয়নি, মনে হয়েছে তিনি বোধ হয় এই পৃথিবীটারই মালিক। নতুন গাড়ির মালিক যেভাবে আঙুলের ডগায় গাড়ির চাবির রিং ঘুরিয়ে সবাইকে দেখাতে চায়, পুতিনও সেভাবে পারমাণবিক বোমার বোতাম দেখালেন।
তিনি বহুবার বহু জায়গায় বলেছেন, ‘রাশিয়া যদি না থাকে, তাহলে এই দুনিয়ার দরকারটা কী?’ সেসব কথায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু কোনো কিছু রাশিয়ার মনমতো না হলে বাকি সব ধ্বংস হয়ে যাবে—এটা তো একটা হুমকি।’

২০১৮ সালে একটি তথ্যচিত্রে পুতিন বলেছিলেন, ‘কেউ যদি রাশিয়ার ওপর টেক্কা দিতে চায়, তার জবাব দেওয়ার বৈধ অধিকার আমাদের আছে। হ্যাঁ, হতে পারে সেটা এই মানবজাতি আর এই বিশ্বের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। কিন্তু আমি তো রাশিয়ার নাগরিক এবং এ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। সেই বিশ্ব আমি কেন চাইব, যেখানে রাশিয়া নেই?’

চার বছর পর এখন চলছে ২০২২ সাল। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন পুতিন। কিন্তু ইউক্রেনের সৈন্যরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ক্রেমলিনকে অবাক করে দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো অনেক বেশি একজোট হয়ে গেছে। তারা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে মস্কোর বিরুদ্ধে, যার লক্ষ্য রাশিয়াকে পুরো বিশ্ব থেকে আলাদা করে ফেলা, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া। আর সেটা যদি হয়, তাহলে পুতিনের বানানো রুশ কাঠামোই হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।

সব মিলিয়ে পুতিন এখন বেশ চাপের মধ্যে আছেন বলেই মনে করছেন মস্কোভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক পাভেল ফেলজেনহাওয়ার।

‘তার হাতে বিকল্প আসলে খুব বেশি নেই। পশ্চিমারা যখন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক সম্পদ জব্দের সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে, রাশিয়ার আর্থিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হবে।

‘তার হাতে একটা অস্ত্র এখনো আছে, সেটা হলো ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া। তিনি হয়তো ভাবতে পারেন যে গ্যাস আটকে দিলে ইউরোপ রণে ভঙ্গ দেবে।
‘আরেকটা বিকল্প হলো, ব্রিটেন আর ডেনমার্কের মাঝামাঝি উত্তর সাগরে কোথাও একটা পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে দিয়ে পুতিন দেখতে পারেন, তার ফল কী হয়।’

এখন পুতিন যদি শেষ পথটাই নেন, অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন, তার ঘনিষ্ঠ মহলে কেউ কি নেই, যিনি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারেন, তাঁকে থামানোর চেষ্টা করতে পারেন?

দিমিত্রি মুরাতভ বলছেন, রাশিয়ার রাজনীতির ‘এলিটরা’ কখনো জনগণের দিকে থাকেন না, সব সময় তাঁরা থাকেন শাসকের পক্ষে।

আর ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ায় শাসকই হলো দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সেখানে ‘ভারসাম্য’ শব্দটার জায়গা অভিধানের বাইরে খুব বেশি নেই।

পাভেল ফেলজেনহাওয়ারও একমত, মস্কোতে পুতিনের সামনে দাঁড়ানোর জন্য কেউ প্রস্তুত না। আর এ পরিস্থিতি পুরো রাশিয়াকে একটি মারাত্মক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

ইউক্রেনে যে যুদ্ধ বিশ্ব দেখছে, সেটা পুরোপুরি ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধ। তার বাহিনী যদি তাদের সামরিক লক্ষ্য পূরণ করতে পারে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।

আর রাশিয়া যদি হেরে যায়, কিংবা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে, ক্রেমলিন তখন মরিয়া হয়ে ভয়ংকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। এই ভয়টা থাকছেই।

বিশেষ করে, ‘তিনি কখনোই এটা করবেন না’—এমন আস্থা যদি পুতিনের বেলায় রাখা না যায়।