পুলিশি হেফাজতে গ্রেপ্তার আসামি আব্দুর রহমান। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ।

চট্টগ্রামের খুলশী থানা এলাকায় চাঞ্চল্যকর সালাউদ্দিন হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন ও জড়িত আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রো।

পিবিআই প্রধান, অ্যাডিশনাল আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার), পিপিএম এর তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিট প্রধান পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা, পিপিএম-সেবার নেতৃত্বে একটি আভিযানিক দল ৩ মার্চ বিকেল সোয়া ৫টার সময় অভিযান চালিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ধানমন্ডি থানাধীন মিনা বাজারের সামনের রাস্তা থেকে সন্দেহভাজন আসামি আব্দুর রহমানকে (৩২) গ্রেপ্তার করে।

জানা গেছে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার দিকে সিএমপির খুলশী থানাধীন টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনির পরিত্যক্ত ১১নং বিল্ডিংয়র সামনে ছেনোয়ারা বেগম ছেনুর টিনশেড ঘরের ভেতর মো. সালাউদ্দিন শেখ (৪৫) নামের এক ব্যক্তির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়।

প্রাথমিকভাবে খুলশী থানা পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।

প্রাথমিকভাবে জানা যায়, অজ্ঞাতনামা আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে সালাউদ্দিনকে ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার মধ্যে যেকোনো সময় জবাই করে হত্যা করে লাশ বর্ণিত ঘটনাস্থলে ফেলে যান।

এ ঘটনায় খুলশী থানার এসআই জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করলে তা ২৮ ফেব্রুয়ারি মামলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

এ খুনের ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে এবং ঘটনাটি সম্পূর্ণ ক্লু-লেস হওয়ায় পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো মামলার রহস্য উদঘাটনে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। মামলা হওয়ার পর পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো তা অধিগ্রহণ করে।

প্রথমে ভিকটিম সালাউদ্দিনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা বের করা হয়। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। কিন্তু বসবাস করতেন চট্টগ্রামের খুলশী থানা এলাকায়।

ব্যাপক গোয়েন্দা তৎপরতা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও নিরবচ্ছিন্ন অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন আসামি আব্দুর রহমানকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধৃত আসামি ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভিকটিম সালাউদ্দিন, আসামি আব্দুর রহমান এবং অপর পলাতক আসামি জনৈক সিলেটি স্বপন ছেনোয়ারা বেগম ছেনুর টিনশেড ঘরের ভাড়াটে ছিলেন। প্রথমে ভিকটিম সালাউদ্দিন ও পলাতক আসামি সিলেটি স্বপন ওই কক্ষে ভাড়া থাকতেন। আসামি আব্দুর রহমান টাইগার পাস ঘুরাইন্না গেট এলাকায় জনৈক দুলালের চায়ের দোকানে কাজ করতেন। ওই চায়ের দোকানে আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে ভিকটিম সালাউদ্দিন ও সিলেটি স্বপনের সাথে আসামি আব্দুর রহমানের পরিচয় হয়।

পরে থাকার সমস্যা হওয়ায় আব্দুর রহমান, সালাউদ্দিন ও সিলেটি স্বপন একসাথে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বসবাস শুরু করেন। একই রুমে ভাড়া থাকার সূত্রে ৩ জন একই সাথে হালিশহর আবাহনী মাঠ ও পলোগ্রাউন্ড বাণিজ্য মেলার বিভিন্ন স্টল তৈরির কাজ করেন। কাজের মজুরির টাকা ভিকটিম সালাউদ্দিন গ্রহন করতেন। কাজের বিনিময়ে প্রাপ্ত টাকা ভিকটিম সালাউদ্দিন কম বলতেন মর্মে সিলেটি স্বপন ও আব্দুর রহমান ধারণা করতেন। এই নিয়ে সালাউদ্দিনের সাথে প্রায়ই তাদের ঝগড়া-বিবাদ হত। ভিকটিমদের বাসায় ব্যবহারের পানি কিনে ব্যবহার করতে হত। ভিকটিম সালাউদ্দিন বেশি পানি ব্যবহার করতেন মর্মে দাবি করে আসামিদের সাথে প্রায় তার ঝগড়া-বিবাদ হতো। এরই এক পর্যায়ে সিলেটি স্বপন ভিকটিম সালাউদ্দিনের কাছে তার আগের মজুরি বাবদ সাত হাজার টাকা দাবি করলে সালাউদ্দিন তিন হাজার পাঁচশত টাকা বকেয়া থাকার কথা স্বীকার করেন এবং তার মধ্যে দুই হাজার টাকা পরিশোধ করেন। অবশিষ্ট এক হাজার পাঁচশ সিলেটি স্বপনকে পরিশোধ করতে রাজি হলেও সিলেটি স্বপন তা মানতে চাননি। যার ফলে বিরোধ আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এরই একপর্যায়ে ঘটনার অনুমান সপ্তাহখানেক আগে আসামি আব্দুর রহমান ও সিলেটি স্বপন ভিকটিম সালাউদ্দিনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা একটি ধারালো ছুরি কিনেন।

ঘটনার দিন ২৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটি স্বপন ও আব্দুর রহমান কাজে না গিয়ে বাসায় অবস্থান করছিলেন। রাত অনুমান ১০টার দিকে ভিকটিম সালাউদ্দিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে আসেন এবং কিছুক্ষণ মোবাইল ফোন দেখে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর আব্দুর রহমান ও সিলেটি স্বপন কিছুক্ষণ ছক্কা খেলে তারাও ঘুমিয়ে পড়েন। পরিকল্পনা মোতাবেক রাত ১টার দিকে সিলেটি স্বপন ঘুম থেকে উঠেন এবং আব্দুর রহমানকে জাগিয়ে তোলেন।স্বপন প্রথমে ছুরি দিয়ে ঘুমন্ত সালাউদ্দিনের গলায় আঘাত করেন এবং আব্দুর রহমান ভিকটিমের দুই হাত চেপে ধরেন। এরপর সিলেটি স্বপনের হাত থেকে ছুরি নিয়ে আব্দুর রহমান সালাউদ্দিনের গলায় একটি আঘাত করেন। তখন সালাউদ্দিন আব্দুর রহমানের হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিতে চাইলে তার ডান হাতে কেটে যায় এবং আব্দুর রহমানের কব্জির উপরেও জখম হয়। আঘাতের তীব্রতায় সালাউদ্দিনের দেহ নিস্তেজ হলে আব্দুর রহমান তার নিজের হাতের কাটা অংশ রুমাল দিয়ে বেধে নেন এবং রুমে থাকা গামছা দিয়ে ভিকটিম সালাউদ্দিনের দুই হাত বাঁধেন। সিলেটি স্বপন সালাউদ্দিনের দুই পা ওড়না দিয়ে বাঁধেন। পরবর্তীতে তারা রুমে থাকা আরেকটি গামছা ও কম্বল দিয়ে সালাউদ্দিনের মুখ ঢেকে দেন। এরপর আব্দুর রহমান ও সিলেটি স্বপন সালাউদ্দিনের মানিব্যাগে থাকা ৩৫০ টাকা ভাগ করে নেন এবং সালাউদ্দিনের মোবাইল ফোন আব্দুর রহমান নিজের কাছে রাখেন। এরপর তারা রুমের দরজা বন্ধ করে রিকশা করে অলংকার যান। তারা সেখান থেকে বাসে করে ফেনী যান । পরে ফেনী থেকে সিলেট যান। সিলেট থেকে তারা উভয়ে নরসিংদী যান। সেখানে সিলেটি স্বপন কাজের জন্য থেকে যান এবং আব্দুর রহমান নারায়ণগঞ্জে তার মামার বাসায় যান। সেখানে একদিন থেকে কুমিল্লার চান্দিনায় তার শ্বশুরের বাসায় যান। পরবর্তীতে পুলিশি অভিযানের মুখে আব্দুর রহমান পালিয়ে ঢাকার ধানমন্ডি তার স্ত্রীর কাছে চলে যান। পিবিআই টিম তাকে ৩ মার্চ বিকেলে ধানমন্ডি থানাধীন মিনাবাজারের সামনের রাস্তা থেকে গ্রেপ্তার করে।

পলাতক আসামি সিলেটি স্বপনকে গ্রেপ্তারের জোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। ধৃত আসামি আব্দুর রহমানকে আজ ৪ মার্চ চট্টগ্রামের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করা হয় এবং ৭ দিন পুলিশ রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন দাখিল করা হয়।