লঞ্চের কেবিনে সাবেক স্বামীকে হত্যার অভিযোগে পিবিয়াইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আরজু আক্তার। ছবি: পিবিআই

ঢাকা থেকে ভোলাগামী গ্রিনলাইন-৩ লঞ্চের কেবিনে জাকির হোসেন বাচ্চু (৩৮) নামের এক তরুণকে হত্যার অভিযোগে মোছা. আরজু আক্তার (২৩) নামের এক তরুণীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা জেলা পুলিশ।

মঙ্গলবার রাত তিনটার দিকে সাভারের নবীনগর এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরজু আক্তার বোরহানউদ্দিন থানার চরটিকটা গ্রামের মৃত হাফিজ উদ্দিনের মেয়ে। হত্যাকাণ্ডের শিকার জাকির হোসেন বাচ্চু (৩৮) একই থানাধীন পূর্ব মহিষখালি গ্রামের ফরাজি বাড়ির মো. সিদ্দিক ফরাজির ছেলে।

এ ঘটনায় নিহত বাচ্চুর প্রথম স্ত্রী সুরমা আক্তার বাদী হয়ে গত ৩১ জুলাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, তাঁর স্বামী বাচ্চু ২০২০ সালের এপ্রিলে আরজু বেগমকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর বাচ্চু কিছুদিন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুর সঙ্গে বসবাস করে এবং একপর্যায়ে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের দিকে দ্বিতীয় স্ত্রী আরজু বেগমকে ডিভোর্স দেন। কাজের সুবাদে বাচ্চু ও তাঁর স্ত্রী বাচ্চুর বড় ভাইয়ের স্ত্রী মিনারার (৩০) বাসায় থাকতেন। গত ২৯ জুলাই সকাল সাতটার দিকে বাচ্চু লঞ্চে করে বাড়িতে আসবেন বলে জানান। পরে ওই দিন সুরমা তাঁর স্বামীকে একাধিক ফোন দিলেও সংযোগ বন্ধ পান। যথাসময়ে বাড়িতে না আসায় সুরমার সন্দেহ হয় এবং আত্মীয়স্বজনকে জানান। সুরমা ও তাঁর আত্মীয়স্বজন তাঁকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। একপর্যায়ে সদরঘাট নৌ থানার মাধ্যমে সুরমা সংবাদ পান, গত ২৯ জুলাই রাত আটটার দিকে সদরঘাটে থাকা এমভি গ্রিন লাইন-৩ লঞ্চের ৩য় তলার কেবিনের ভেতরে খাটের নিচে বাচ্চুর লাশ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ওই লঞ্চের স্টাফদের মাধ্যমে সুরমা জানতে পারেন, ওই লঞ্চের কেবিনে তাঁর স্বামীর সঙ্গে কফি কালারের বোরকা পরা মুখ ঢাকা অবস্থায় একটি মেয়ে ছিল।

নিহত জাকির হোসেন বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

মামলাটি পিবিআইয়ের শিডিউলভুক্ত হওয়ায় পিবিআই ঢাকা জেলা স্ব-উদ্যোগে মামলাটির তদন্ত অধিগ্রহণ করে। অ্যাডিশনাল আইজিপি, পিবিআই বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার), পিপিএমের তত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় পিবিআই ঢাকা জেলা ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম পিপিএম-সেবা এর সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিরস্ত্র) মো. আনোয়ার হোসেন তদন্ত করে রহস্য উদঘাটন করেন।

আরজু জানান, মৃত জাকির হোসেন বাচ্চু দুই বছর আগে জিনের বাদশা পরিচয়ে আরজু আক্তারকে ফোন দেন। তারপর থেকে আরজু আক্তারের সাথে পরিচয়, প্রেম ও পরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বাচ্চু। বাচ্চু আসামি আরজু আক্তারকে জিনের বাদশা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে এবং তাঁকেও এই কাজে পারদর্শী করেন। আরজুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ থাকার পরও জাকির হোসেন বাচ্চু একাধিক নারীর সাথে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। জিনের বাদশার পরিচয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বাচ্চু যে অর্থ উপার্জন করতেন, তা অনৈতিক কাজে খরচ করতেন। এসব বিষয় নিয়ে আরজু আক্তারের সঙ্গে জাকির হোসেন বাচ্চুর ব্যাপক মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে প্রায় ৫ মাস আগে দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুকে তিনি তালাক দেন। আরজু আক্তারকে তালাক দেওয়ার পরও জাকির হোসেন তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখেন। জাকির হোসেন বাচ্চুর পুনরায় একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কের বিষয়টি আরজুর কাছে ধরা পড়ে। এতে আরজু আরও বেশি ক্ষিপ্ত হন এবং বাচ্চুকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ঘটনার আগের দিন রাতে বাচ্চু তাঁর এক পরকীয়া প্রেমিকার সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন। বিষয়টি আরজু আক্তার বুঝতে পারেন। বাচ্চু ২৯ জুলাই শুক্রবার ঢাকা থেকে লঞ্চে গ্রামের বাড়ি ভোলা যাবেন বলে জানতে পারেন আসামি আরজু। আরজু বাচ্চুকে লঞ্চের একটি কেবিন ভাড়া করে তাঁকেও বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন। বাড়ি একই এলাকায় পাশাপাশি গ্রামে হওয়ায় বাচ্চু ঢাকা থেকে ভোলাগামী এমভি গ্রিন লাইন-৩ লঞ্চের একটি স্টাফ কেবিন ভাড়া করেন। ভাড়া নেওয়ার সময় তাঁরা স্বামী স্ত্রী পরিচয় দিয়ে লঞ্চে ওঠেন। কেবিন ভাড়া নেওয়ার সময় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাছ থেকে কোনো তথ্য রাখেননি। লঞ্চে ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত আসামি আরজু আক্তার বোরকা পরা এবং মুখ ঢাকা অবস্থায় ছিলেন।

জিজ্ঞাসাবাদে আরজু আক্তার জানান, সকাল আটটার দিকে তাঁরা সদরঘাট থেকে ভোলার ইলিশা যাওয়ার জন্য লঞ্চে ওঠেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আরজু দুধের সঙ্গে ৫টি ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে লঞ্চে ওঠেন। বাচ্চু এক বাটি রসমালাই ক্রয় করেন। লঞ্চের কেবিনে ওঠার পর তাঁরা শারীরিক মেলামেশা করেন। ঘন্টাখানেক পর আরজু আক্তার ঘুমের ওষুধমিশ্রিত দুধ বাচ্চুকে খাইয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে জাকির হোসেন অচেতন হয়ে গেলে ওড়না দিয়ে জাকির হোসেনের হাত এবং পা বেঁধে ফেলেন। পরে অন্য একটি ওড়না দিয়ে জাকির হোসেনকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। হত্যার পর জাকির হোসেনের লাশ কেবিনের স্টিলের খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন। লঞ্চটি ভোলার ইলিশা ঘাটে পৌঁছালে আরজু নেমে যান। ওই দিন বেলা আড়াইটার দিকে লঞ্চটি ইলিশা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। লঞ্চের স্টাফরা ওই কেবিন তিনজন বাচ্চাসহ দুই নারীকে ভাড়া দেন। লঞ্চটি ঘাট ছেড়ে আসার প্রায় দুই ঘন্টা পর নারীদের সঙ্গে থাকা একটি বাচ্চা খাটের নিচে প্রবেশ করে। একজন নারী খাটের নিচ থেকে বাচ্চাটিকে আনতে গেলে লাশ দেখে চিৎকার শুরু করলে বিষয়টি লঞ্চের স্টাফদের নজরে আসে। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সদরঘাট এসে বিষয়টি ঢাকা সদরঘাট নৌ থানা পুলিশকে অবহিত করলে সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের জন্য পিবিআইকে অবহিত করে। পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের ক্রাইমসিন টিম নিহত জাকির হোসেন বাচ্চুর পরিচয় শনাক্তের পর বিষয়টি পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশকে অবহিত করে।

পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশের চৌকস একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। পরে গত ৩১ জুলাই ১ম স্ত্রী সুরমা আক্তার বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি পিবিআইয়ের শিডিউলভুক্ত হওয়ায় ১ আগস্ট পিবিআই ঢাকা জেলা স্ব-উদ্যোগে মামলাটির তদন্ত অধিগ্রহণ করে। মামলাটি অধিগ্রহণ করার ৪৮ ঘন্টার আগেই আসামিকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই ঢাকা জেলা।

আসামি আরজু আক্তার গত ২ জুলাই হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মিশকাত শুকরানার কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।