কুমিল্লায় সম্প্রতি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সারা দেশে ৭২টি মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৫০ জনকে। দ্রুততার সঙ্গে ঘটনার রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তি নির্ভর তদন্ত কার্যক্রম চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও উসকানি রোধে চলছে সাইবার মনিটরিং। এই পরিস্থিতিতে তথ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহযোগিতা করতে দেশের সব নাগরিকের প্রতি প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ।

২০ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ওই অনুরোধ জানানো হয়। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (ইন্সপেকশন), অতিরিক্ত দায়িত্বে এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) মোহাম্মদ শাহ জালালের স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের বক্তব্য তুলে ধরা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে সাতটায় কুমিল্লা সদর থানার নানুয়া দীঘির উত্তর পাড়ে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে কে বা কারা পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে চলে যায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় স্বার্থান্বেষী দুষ্কৃতিকারী উসকানিমূলক ও বিকৃত প্রচারণা চালায় এবং পরবর্তীতে আরও উচ্ছৃঙ্খল দুষ্কৃতিকারী সংঘবদ্ধ হয়ে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের চেষ্টা করে ও পূজামণ্ডপে ইট-পাটকেল ছোড়ে। এ ছাড়া দুষ্কৃতিকারীরা শহরের কাপড়িয়া পট্টি কলোনির চানমনি পূজামণ্ডপ, শ্রী শ্রী রক্ষাকালী মন্দির, কালিতলাসহ আরও কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলা চালায় এবং প্রতিমায় অগ্নিসংযোগ করে।

কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে, সে জন্য সারা দেশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ও পুলিশ টহল জোরদার করা এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে ১৩ অক্টোবর রাত সাড়ে আটটায় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ পৌরসভার শ্রী ত্রিনয়নী সংঘ রাজা লক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়া, মোকিমাবাদ পূজামণ্ডপে ৫০০-৬০০ জন দুষ্কৃতিকারী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশ তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করলে তারা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে এবং ৫-৬টি পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করে। দুষ্কৃতিকারীদের ইট-পাটকেলের আঘাতে ১৫ জন পুলিশ সদস্য মারাত্মক আহত হয়। জনগণের জানমাল রক্ষায় এবং আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় পাঁচজন প্রাণ হারায়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কুমিল্লার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ১৪ অক্টোবর সকাল ১১টা ২০ মিনিটে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার ছয়ানী ইউনিয়নের সর্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গা পূজা মন্দিরের কাছে ৮০০-১০০০ উচ্ছৃঙ্খল লোক জড়ো হয়ে উসকানিমূলক স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে তারা লাঠিসোটা নিয়ে মন্দিরের সামনে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও বিজিবির টহল দলের ওপর হামলা চালায়, মন্দিরের মূর্তি ভাঙচুর করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় একজন প্রাণ হারায় এবং পরবর্তীতে পুকুর থেকে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

রংপুরের পীরগঞ্জ থানার বড় করিমপুর মাঝিপাড়া গ্রামে ১৭ অক্টোবর পরিতোষ (১৯) নামের একজন নিজের ফেসবুক আইডিতে পবিত্র কাবা শরীফের অবমাননাকর ছবি আপলোড করে। পরবর্তীতে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রাত প্রায় আটটার সময় স্থানীয় কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী ওই গ্রামের একটি মন্দিরসহ ১৮টি পরিবারের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়।

এ ছাড়া কক্সবাজারের পেকুয়া ও চকরিয়া থানায়, সিলেটের জকিগঞ্জ থানায়, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও কমলগঞ্জ থানায়, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থানায় এবং গাজীপুর মেট্রোপলিটনের কাশিমপুর থানাসহ দেশের আরও কয়েকটি স্থানে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় সারা দেশে মোট সাতজন প্রাণ হারায়। তাদের মধ্যে দুজন হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং পাঁচজন মুসলমান সম্প্রদায়ের। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দায়িত্ব পালনকালে ৫০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৭২টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দুষ্কৃতিকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। থানা-পুলিশের পাশাপাশি পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোও তদন্তে সম্পৃক্ত হয়েছে। দ্রুততার সঙ্গে রহস্য উদঘাটনে প্রযুক্তি নির্ভর তদন্ত কার্যক্রম চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও উসকানি রোধে চলছে সাইবার মনিটরিং। পরিস্থিতির অবনতি রোধে পুলিশ, র্যা ব, বিজিবি এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকারের সব গোয়েন্দা সংস্থা সার্বক্ষণিকভাবে কড়া নজরদারি অব্যাহত রেখেছে।

বিজ্ঞপ্তিতে জনসাধারণের উদ্দেশে আরও বলা হয়, যেকোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য অথবা গুজব কিংবা উসকানিতে বিভ্রান্ত বা উত্তেজিত না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে এবং পরিস্থিতির উন্নয়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে দেশের সব নাগরিকের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ।