অজ্ঞান পার্টির ১০ সদস্যসহ গ্রেপ্তার ১৫ জন। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশ।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় দায়ের করা তিনটি হত্যা মামলাসহ চারটি মামলায় অজ্ঞান পার্টির ১০ সদস্যসহ ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

১ নম্বর মামলা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় সংঘবদ্ধ অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা অটোরিকশাচালক খোরশেদ আলমকে (৫৭) সিরাজদীখানের নিমতলী থেকে শ্রীনগর যাবে বলে ভাড়া করে শ্রীনগর পেট্রলপাম্পে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে তাঁরা কৌশলে খোরশেদকে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে শরবত খাইয়ে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অটোচালক খোরশেদ জ্ঞান হারিয়ে ফেললে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাঁকে শ্রীনগর থেকে নিয়ে এসে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ের টোলপ্লাজা-সংলগ্ন রাস্তার পাশে ফেলে রেখে তাঁর অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যান। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে ভিকটিম খোরশেদকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। পরে ভিকটিম খোরশেদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ নভেম্বর মারা যান। এ ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি অটো ছিনতাইসহ হত্যা মামলা দায়ের হয়।

২ নম্বর মামলা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অটোচালক আলম বেপারী (৭০) তাঁর অটোরিকশা নিয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন রামেরকান্দা যান। সেখান থেকে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বআলম বেপারীর অটো ভাড়া করে কোনাখোলা নিয়ে আসেন। তারপর আলম বেপারীকে পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো চা খাওয়ান। কিছুক্ষণের মধ্যে আলম বেপারী জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাঁকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন রাজাবাড়ী রোডের পাশে ফেলে দিয়ে তাঁর অটো নিয়ে পালিয়ে যান অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। পরে স্থানীয় জনতা আলম বেপারীকে অচেতন অবস্থায় পেয়ে চিকিৎসার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং হাসপাতালে গিয়ে আলম বেপারীর শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেয়। পরে ৫ ডিসেম্বর আলম বেপারী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি অটো ছিনতাইসহ হত্যা মামলা হয়।

৩ নম্বর মামলা থেকে জানা যায়, গত বছরের ৯ অক্টোবর রাতে অটোরিকশাচালক আব্দুর রহিম (৪২) তাঁর অটোরিকশা নিয়ে বের হন। কিন্তু আর ঘরে ফিরে আসেননি। পরে জানা যায়, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা আব্দুর রহিমকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন জিনজিরার কালাচান মার্কেটের বারান্দায় ফেলে রেখে তাঁর অটো নিয়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় ৯৯৯ এর মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা-পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অচেতন অবস্থায় আব্দুর রহিমকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং তার পরিবারকে খবর দেয়। পরে আব্দুর রহিম চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ অক্টোবর মারা যান। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি অটো ছিনতাইসহ হত্যা মামলা হয়।
৪ নম্বর মামলা সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ ৯৯৯ এর মাধ্যমে খবর পায়, একজন লোক অচেতন অবস্থায় ঝিলের মধ্যে পড়ে আছেন। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা-পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে অচেতন অবস্থায় লোকটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে ৪ দিন কোমায় থেকে লোকটির জ্ঞান ফিরে এলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাঁর নাম হাসান, তিনি একজন প্রতিবন্ধী এবং অটোচালক। হাসান ঘটনার বিষয়ে জানান, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাঁকে মিরপুর থেকে মোহাম্মদপুর যাবে বলে ভাড়া করে কেরানীগঞ্জে নিয়ে আসেন এবং তাঁকে চেতনানাশক ওষুধ মেশানো কফি খাইয়ে অজ্ঞান করে ফেলে দিয়ে তাঁর অটো নিয়ে পালিয়ে যান। তিনি এর আগে কোনো দিন কেরানীগঞ্জে আসেননি। পরে এ ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি অটো চুরির মামলা হয়।

একের পর এক অজ্ঞান পার্টির এ ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান পিপিএম (বার) দ্রুত সংঘবদ্ধ এ অজ্ঞান পার্টিকে ধরার জন্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আমিনুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ক্রাইম অ্যান্ড অপস এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে শাহাবুদ্দীন কবির বিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কেরানীগঞ্জ সার্কেলের নেতৃত্বে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার একটি চৌকস তদন্ত টিম সংঘবদ্ধ হয়ে অজ্ঞান পার্টিকে ধরার জন্য ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে। তদন্ত টিম প্রতিটি ঘটনার প্রকৃতি ও যোগসূত্র বিচার-বিশ্লেষণ করে তথ্য সংগ্রহ করে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে ঘটনার সাথে জড়িত আসামিদের শনাক্ত করে তাদের অবস্থান নির্ণয় করে।

এর ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শাহ্জামানের নেতৃত্বে একটি চৌকস আভিযানিক দল কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এবং ডিএমপির বিভিন্ন এলাকা থেকে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে উল্লিখিত মামলার ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত সংঘবদ্ধ আন্তজেলা অজ্ঞান পার্টির ১০ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে।

তাঁরা হলেন বাদশা (৩৫), ওলি (৩৪), সুলতান (৫৮), সুমন কারাল (২৭), বিরিয়ানি সুমন (৩৫), শাহিন (২৮), আলামিন ওরফে অনিক (২৮), জামাল (৩০), মনির (২৭), আশরাফ (৪২)।

গ্রেপ্তার আসামিদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে ওই চার মামলার ঘটনায় লুন্ঠিত ৪টি অটো উদ্ধার এবং চোরাই অটো ক্রয়-বিক্রয়কারী ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাঁরা হলেন গ্যারেজ বাদশা (২৮), জুয়েল (৩৯), বাচ্চু (৫৫), রাজু (৪১) ও সাইদুর (৩৮)।

অভিযানকালে অজ্ঞান পার্টির সদস্য সুমন কারালের একটি প্রোবক্স গাড়ি জব্দ করা হয়।

গ্রেপ্তার আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। আসামিদের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা আছে। মামলার তদন্ত অব্যাহত আছে।