ঢাকা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটারের দূরত্ব। মহাসড়ক পেরিয়ে খানিকটা এগোলেই কোলাহলমুক্ত সবুজে ঢাকা মনোরম পরিবেশ। কখনো কানে ভেসে আসে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। সত্যিই মন ভালো করে দেওয়ার মতো এক পরিবেশ। আর এমনই এক পরিবেশে বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্ট গড়ে তুলেছে মাদকাসক্তি নিরাময় ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্র। নাম দিয়েছে ‘ওয়েসিস’।

ওয়েসিস সাততলা ভবন। রাস্তা লাগোয়া হওয়ায় খুব সহজেই কেউ চাইলে গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পুরো ভবনের ভেতরে-বাইরে সিসিটিভি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনাহূত ব্যক্তিদের ভবনে প্রবেশ ও বহির্গমন ঠেকানো নিশ্চিত করতে আছে ২৪ ঘণ্টার নিরাপত্তাকর্মী।

সকাল তখন ৮টা। ভবনে প্রবেশ করতে গেলে নিরাপত্তারক্ষী পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় দিতেই মিষ্টি হাসি দিয়ে একজন কর্মী এগিয়ে এলেন। কোভিড-১৯-এর কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম।

ঢুকতেই চোখের সামনে পড়ল রিসেপশন। সেখানে কর্তব্যরত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ২৪ ঘণ্টাই রিসেপশনে লোক থাকেন। মানে, আপনি যখনই ফোন করবেন, কাউকে না কাউকে পাবেন। হাতের বাম পাশেই বহির্বিভাগ। সেখানে একজন চিকিৎসক দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সঙ্গে কথা হলো চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। তিনি জানালেন, এখানে কোনো ব্যক্তি রোগী হিসেবে আসামাত্রই তাঁর প্রাথমিক শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। এরপর রোগীর প্রাথমিক হিস্ট্রি নিয়ে নির্ধারণ করা হয় রোগীর আসলে কোন চিকিৎসা প্রয়োজন। আর যদি ভর্তি করানোর প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই পরামর্শও এখান থেকে দেওয়া হয়।

ভবনটিতে ওঠানামার জন্য ২৪ ঘণ্টার বৈদ্যুতিক সুবিধাসহ লিফট আছে। আছে সিঁড়িও। যেহেতু ঘুরে দেখব, তাই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেলাম। এটি প্রশাসনিক ব্লক। পরিপাটি। আয়োজন দেখে কেউ বিলাসবহুল হোটেলও মনে করতে পারেন। ফ্লোরের এক পাশে প্রশাসনিক ব্লকের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের কক্ষ রয়েছে। সেখানকার দায়িত্বরত কর্মকর্তা ঘুরে ঘুরে দেখানোর সময় জানালেন, অভিজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সাইকিয়াট্রিক, সাইকোলজিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট, ইয়োগা এক্সপার্ট ও অভিজ্ঞ অ্যাডিকশন কনসালট্যান্টদের বসার ব্যবস্থা এই ফ্লোরে করা হয়েছে। রোগীকে এই ফ্লোর থেকে চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি কাউন্সেলিং করা হবে। এ ছাড়া রোগীকে রেসকিউ করতে ওয়েসিসের একটি প্রশিক্ষিত টিম ও অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। যদি কোনো রোগীকে বাসা থেকে নিয়ে আসার প্রয়োজন হয়, তাহলে সেই সহযোগিতাও প্রদান করে ওয়েসিস। সবকিছু যাতে সহজে জানতে পারি, এ জন্য ওই প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে সঙ্গী করে এগোলাম।

এরপর তৃতীয় তলায় গেলাম। ঢুকতেই নার্স স্টেশনে দায়িত্বরত একজন নার্সকে পেলাম। হাসিমুখে তিনি স্বাগত জানালেন। ডিউটি ডাক্তারের কক্ষের দিকে এগোতেই একটি কক্ষ চোখে পড়ল। সঙ্গে থাকা প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে আবাসন সুবিধার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ওয়েসিসে মোট ৫ ধরনের কক্ষ রয়েছে। এগুলো হলো: প্লাটিনাম ক্যাটাগরির একক ডিলাক্স এসি রুম, সুপিরিয়র ক্যাটাগরির ডাবল শেয়ারিং ডিলাক্স এসি রুম, ডিলাক্স ক্যাটাগরির ট্রিপল শেয়ারিং এসি রুম, স্ট্যান্ডার্ড নন-এসি কেবিন এবং স্ট্যান্ডার্ড নন-এসি রুম। আগত রোগী তাঁর ইচ্ছেমতো যেকোনো কক্ষ বেছে নিতে পারেন। কথা বলতে বলতে ডিউটি ডাক্তারের কক্ষে এসে গেছি। এখানেও ২৪ ঘণ্টার জন্য চিকিৎসক থাকেন। শিফটিং ডিউটি, যাতে ভর্তি রোগীকে সার্বক্ষণিকভাবে সর্বোত্তম সেবাটি দেওয়া যায়।

ওই প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানান, নারী রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ফ্লোর করেছে ওয়েসিস। নারীদের ফ্লোরে প্রবেশ করামাত্রই ভিন্ন একটি ‘লুক’ চোখে পড়ল। রুমের দেয়াল থেকে শুরু করে জানালার পর্দা— সবকিছু ভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে। এটি যে নারীদের কক্ষ, সেটি না বললেও সহজে বোঝা যায়। সঙ্গে থাকা ওই কর্মকর্তা জানান, নারী রোগীদের জন্য নারী চিকিৎসক ও নার্স রয়েছেন। এই ফ্লোরে সাধারণত কোনো পুরুষ প্রবেশ করবেন না।

কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে পঞ্চম তলায় পৌঁছে গেলাম, বুঝতেই পারলাম না। সেখানে ইনডোর গেমসের জন্য বিলিয়ার্ড ও টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। আগত রোগীদের মধ্যে যাঁরা বই পড়তে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য লাইব্রেরি রয়েছে।

এরপর ভবনের ছাদে পৌঁছালাম। মনে হলো, এটা তো ছাদ নয়— বাগান। চারদিকে ফুল আর গাছ। সাজানো। এর মধ্যেই রয়েছে বসার ব্যবস্থা। ওপরে খোলা আকাশ আর তার মধ্যে এমন ফুলশোভিত ছাদে বুকভরা মুক্ত বাতাস যে কারও মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
ছাদের এক পাশে রয়েছে আগত রোগীদের আধুনিক সব সুবিধাসংবলিত একটি ব্যায়ামাগার। সেখানে নিয়মিত রোগীদের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শরীরচর্চার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর ফুলশোভিত ছাদবাগানে রোগীদের জন্য রয়েছে মেডিটেশন ও ইয়োগা করার সুযোগ।

সঙ্গে থাকা ওয়েসিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে নিয়ে লিফটে নামতে নামতে তিনি জানালেন, এখানে আগত রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি নিজ নিজ ধর্মীয় বিধিবিধানগুলো অনুসরণের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে কোনো রোগী ভর্তি হওয়া মাত্রই তাঁকে একটি লাইফ ম্যানেজমেন্ট প্রটোকলের মধ্যে নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ রোগীর ঘুম, খাওয়া, ইনডোর গেমস, জিম থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজ একটি নিয়মের মধ্য দিয়ে যাবে।
এখানকার চিকিৎসকেরা নিয়মিত রোগীদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রশিক্ষিত নার্স ও ওয়ার্ডবয়গণ রোগীর সার্বক্ষণিক দেখভাল করবেন। রোগীদের পুনরায় সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাঁদেরকে জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে এখানে এমন একটি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি খুব কম সময়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের এই প্রতিষ্ঠানে ন্যায্যমূল্যে আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হওয়ায় নিরাপত্তার ঝুঁকি নেই। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখানে আগত রোগীদের পরিচয় গোপন রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে; অর্থাৎ সব সময় রোগীর পরিচয় গোপন রাখতে ওয়েসিস অঙ্গীকারবদ্ধ।

বাংলাদেশ পুলিশ কল্যাণ এই প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিতে ফোন করুন 01320 225 699, 01320 225 698 নম্বরে, অথবা ইমেইল করুন oasisbp2021@gmail.com ঠিকানায়। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট www.oasisbp.com এ ভিজিট করেও বিস্তারিত জানতে পারেন। কেউ সরাসরি যোগাযোগ করতে চাইলে চলে আসুন এই ঠিকানায়: ওয়েসিস, প্লট ১০১০, ব্লক-এ, বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্প, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।

মো. ইমরান আহমেদ, সহকারী পুলিশ সুপার, মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি, বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা।