রাজন ও তার স্ত্রী-পুত্র।

নিজের স্ত্রীকে সংসারে ফিরিয়ে নিতে অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন এক যুবক। কৌশলের আদ্যোপান্ত জেনে তাঁর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সাইফুল ইসলাম। যুবক ফিরে পান স্ত্রী ও সন্তানকে।

২ অক্টোবর গভীর রাতে আলমডাঙ্গায় শ্বশুরবাড়ির কাছে মেহগনি বাগানে হাত-পা-মুখ বেঁধে নিজের জীবনকে সংকটাপন্ন করে তোলার অভিনয় করে স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন রাজন নামের ওই যুবক। তিনি গোঙানির মতো শব্দ করতে থাকেন।

এ সময় পার্শ্ববর্তী বালু ব্যবসায়ী মাহমুদুলের নৈশপ্রহরী শীতল আলী মানুষের গোঙানির শব্দ শুনে মেহগনি বাগানে এগিয়ে যান। টর্চের আলোর সাহায্যে হাত-পা বাঁধা প্রায় অচেতন এক যুবককে দেখতে পান। তিনি তখন আলমডাঙ্গা থানায় ফোন করে ঘটনাটি জানান।

ফোন পেয়ে থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম জরুরি ডিউটিতে কর্তব্যরত এএসআই শিপন রানাকে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ভিকটিমকে উদ্ধার করার নির্দেশ দেন। পুলিশ ওই যুবকের কাছে গিয়ে মোটা দড়ি দিয়ে হাত-পা বাঁধা এবং কাপড় দিয়ে মুখটা বাঁধা দেখতে পান। হাত-পা ও মুখের কাপড় খুলে ভিকটিমের নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, তাঁর নাম রাজন, বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চকহারদী গ্রামে। তখন পুলিশ রাজনকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আলমডাঙ্গা থানায় নিয়ে আসেন।

ওসি রাজনের কাছে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তিন বছর আগে আলমডাঙ্গার রাধিকাগঞ্জের স্বামী পরিত্যক্ত নার্গিস বেগমের মেয়ে তুলিকে (ছদ্মনাম) তিনি বিয়ে করেন। তাঁদের সংসারে এক বছর বয়সী একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। রাজন-তুলির সংসার ভালোই চলছিল। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুলি ছেলেকে নিয়ে বেশ কয়েক মাস আগে মায়ের কাছে আলমডাঙ্গায় চলে আসেন। রাজন তাঁর শিশুপুত্র ও স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার আশায় শ্বশুরবাড়িতে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁকে তিন দিন ধরে নির্জন ঘরে আটকে রাখে, শুকনা রুটি, কলা খেতে দেয় এবং সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে। একপর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলে হাত-পা ও মুখ বেঁধে মেহগনি বাগানে ফেলে যায়।

আলমডাঙ্গা থানা-পুলিশ দ্রুত রাজনের শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা করে সেখানে পৌঁছে জানতে পারে, রাজনের শাশুড়ি, স্ত্রী, পুত্র চুয়াডাঙ্গাতে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন। পুলিশের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। পুলিশ দ্রুত চুয়াডাঙ্গা শহরের আত্মীয়ের বাড়িতে এসে রাজনের শাশুড়ি, স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে আলমডাঙ্গা থানায় নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদে রাজনের শাশুড়ি ও স্ত্রী রাজনের দাবিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। একপর্যায়ে ওসি রাজনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং জিজ্ঞাসাবাদে কথার গরমিল পাওয়া যায়। একপর্যায়ে রাজন স্বীকার করেন, তাঁর স্ত্রীকে ফিরে পেতে অনেক দেনদরবার করেও কোনো কাজ হয় না। কোনো কিছুতেই স্ত্রীর মন গলে না। উল্টো রাজনের নামে চুয়াডাঙ্গার আদালতে মিথ্যা মামলা ঠুকে দেন। এ ঘটনায় দিশাহারা হয়ে পড়েন রাজন। স্ত্রী-সন্তানকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন রাজন। কী করলে বউ-ছেলে ফিরে পাওয়া যায়, সেই কৌশল আঁটতে থাকেন। রাজন স্ত্রীর মন গলাতে আলমডাঙ্গায় শাশুড়ির বাড়িতে আসেন। কিন্তু কোনো পাত্তা পাননি। দিশাহারা রাজন এরপর শ্রীরামপুরে তাঁর এক খালাতো ভাইয়ের সহযোগিতা চান। দুই ভাই মিলে নাটক সাজান। পরিকল্পনা অনুযায়ী শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে আলমডাঙ্গা থানাধীন মহিলা কলেজ-সংলগ্ন মীর এলপিজি গ্যাস স্টেশনের পেছনে মেহগনি বাগানে যান তাঁরা। খালাতো ভাই ঝন্টু মোটা দড়ি দিয়ে রাজনের হাত-পা ও শক্ত করে মুখটাও বাঁধে। এরপর ঝন্টু চলে গেলে রাজন গোঙাতে থাকেন। মূলত রাজন স্ত্রীর সহানুভূতি পেতে অভিনব এই কৌশলের আশ্রয় নেন।

এরপর রাজনের নির্দোষ নাটকের আদ্যোপান্ত জেনে থানার ওসি তুলি ও তাঁর মা নার্গিস বেগমকে ঘটনার বিষয়ে জানান। গভীর রাতের নাটকের কাহিনি জেনে রাজনের স্ত্রীর মন গলে যায়। স্বামীর প্রতি তাঁর মায়া জেগে ওঠে। তুলি স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়িতে যেতে রাজি হন।

রোববার দুপুরের পর রাজন তাঁর স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে নিজ বাড়িতে চলে যান।