রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে গতকাল পরিবেশিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী ‘এসো ফিরি আলোর পথে’ পথনাটকের একটি মুহূর্ত। ছবি : বাংলাদেশ পুলিশ

ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উদ্যোগে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদবিরোধী জনসচেতনতামূলক পথনাটক ‘এসো ফিরি আলোর পথে’ প্রদর্শন করা হয়েছে। শুক্রবার (৩১ মে) সন্ধ্যায় ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে ‘চেতনায় বাঙালি সংস্কৃতি, উগ্রবাদ নয় সম্প্রীতি’ প্রতিপাদ্যে পথনাটকটি মঞ্চায়িত করা হয়। খবর ডিএমপি নিউজের।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) মো. মনিরুল ইসলাম (বিপিএম-বার, পিপিএম-বার)। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান (বিপিএম-বার, পিপিএম-বার)।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আজ থেকে ২৫ বছর আগে আমাদের কবি শামসুর রাহমানকে যখন বাসায় ঢুকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়, যশোরে উদীচী নাট্যমঞ্চে যখন বোমা হামলা হয় এবং তারপর বিভিন্ন সিনেমা হল, সার্কাস প্যান্ডেলসহ বিভিন্ন জায়গায়, পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে যে হামলা হয়, তখন চিন্তা করতাম, এ হামলার কারণটা কী? বুঝতে পারছিলাম না, যারা হামলা করছিল, তারা কেন মনে করছিল, তারা জিহাদ করছে, ইসলাম কায়েম করছে। পরে যখন সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে কাজ করা শুরু করলাম, তখন বুঝলাম, যারা এ ধরনের স্বপ্ন বিক্রি করে শর্টকাটে সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে, সেই স্বপ্ন বিক্রেতা বড়ই ধুরন্ধর।’

তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রবাদ দমন করার জন্য অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও আমরা বেছে নিয়েছি। তারই অংশ হিসেবে আজকের এই নাটকটি মঞ্চস্থ হলো, যেখানে নাটক ছোট কিন্তু মেসেজ অনেক। কীভাবে হতাশাগ্রস্ত তরুণদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে, সেটি এই নাটকে দেখানো হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রবাদ বৈশ্বিক সমস্যা। শুধু গ্রেপ্তার করে জেলখানায় রেখে এটা দমন করা যাবে না; সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটা বিরাট দায়িত্ব এবং ভূমিকা রয়েছে। সেদিক থেকে আজকে এ নাটক কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পক্ষ থেকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদ থেকে পরিবেশিত হলো, আমি তাদেরকে কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাই।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম। ছবি : বাংলাদেশ পুলিশ

সভাপতির বক্তব্যে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতির শিকড় অনেক গভীরে এবং পুরোনো। এই দেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলে আমরা একসঙ্গে বসবাস করি। সন্ধ্যাবেলায় একদিকে উলুধ্বনি দেওয়া হয় মন্দিরে, পাশেই আজান দেওয়া হয় মসজিদে। একজন মন্দিরে যায়, একজন যায় মসজিদে। এভাবেই আমাদের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আমাদের উৎসব, পূজাপার্বণ সবকিছু সকল ধর্মবর্ণ একসঙ্গে মিলেমিশে উদযাপন করি। এটি সেই বাংলাদেশ, যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই বাঙালি; এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে এই দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। এ দেশের সংবিধান তৈরি করেছিলেন। সেই দেশে আমরা দেখেছি উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদের কালো থাবা।’

ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিশেষ করে উদীচীর অনুষ্ঠানে, ছায়ানটের অনুষ্ঠানে, এক সাথে দেশের ৬৩ জেলায় বোমা হামলা হয়েছে। বাংলা ভাই, আব্দুর রহমানের যুগ ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা নিজেরাই আক্রান্ত হয়েছি ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান হামলায়। এরপর থেকেই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদকে রুখে দেওয়ার জন্য বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল। কেবল বাংলাদেশ নয়, আমেরিকা বা ইউরোপে যারা এগুলো নিয়ে কাজ করে, তারাও বাংলাদেশে যারা জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদবিরোধী কাজ করেন, গবেষণা করেন, তাদের শরণাপন্ন হন, তাদের দেশে কীভাবে জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করা যায় সে জন্য। এটি নিঃসন্দেহে গর্বের।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যে উদ্দেশ্য, সেটা সিটিটিসির মাধ্যমে, অ্যান্টি-টেররিজমের মাধ্যমে, পুলিশিংয়ের মাধ্যমে নয়, আজকের নাটকের মাধ্যমে; সেটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আমরা নাটকে লক্ষ করেছি, পারিবারিক বন্ধন কিছুটা ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতির যে আবহ, সেটি সেভাবে থাকছে না। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে, বাঙালির সংস্কৃতির কাছে ফিরে যেতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতি দিয়েই উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদের মতো অপসংস্কৃতিকে রুখে দিতে চাই; এটি হোক আমাদের আজকের স্লোগান।’

‘এসো ফিরি আলোর পথে’ নাটকে উপস্থাপন করা হয়েছে কীভাবে উগ্রবাদের উসকানিদাতা বা জঙ্গি সংগ্রহকারীরা বিভিন্ন সংগঠনের নাম ধারণ করে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিপথগামী করে, উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হওয়া ব্যক্তির আচরণে কী কী পরিবর্তন ঘটে, উগ্রবাদে জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে কারা ঝুঁকিতে রয়েছে এবং উগ্রবাদ প্রতিরোধে করণীয় কী হতে পারে। ধর্মের আংশিক বা ভুল ব্যাখ্যার বিপরীতে ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা এবং প্রকৃত ধর্মীয় আচরণ কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কেও নাটকটিতে তুলে ধরা হয়েছে।

পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়াভিত্তিক নাট্যচর্চার রীতি প্রয়োগ করা হয়েছে নাটকটিতে। প্রদর্শনীতে উপস্থিত দর্শক নাটকের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারছেন, তার গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিতে পারছেন, এমনকি নাট্যপ্রবাহে যুক্ত হয়ে কখনো কখনো হয়ে উঠেছেন নাটকের অভিনেতা। এ ছাড়া নাটক চলাকালীন গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করে নাটককের গতি বা গল্পের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন উপস্থিত দর্শকেরা। এভাবেই অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে কথোপকথন, যোগাযোগ এবং পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নাটকটি এগিয়ে যায়, ফলে দর্শক নিজেকে নাটকের অংশ মনে করেন।

নাটকটির সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) এর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান (বিপিএম-বার)। জায়েদ জুলহাসের রচনায় নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার খন্দকার রবিউল আরাফাত লেনিন। পরিবেশনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাটা সংসদের সদস্যরা।

সভাপতির বক্তব্য দিচ্ছেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। ছবি : বাংলাদেশ পুলিশ

নাটকটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ে করেছেন আবে হায়াত সৈকত, সানোয়ারুল হক সনি, কামরুন্নাহার মুন্নী, দিগার মো. কৌশিক, নিকুল কুমার মন্ডল, লিপটন ইসলাম, রিভু সরকার শুভ্র, ইভানা মেঘলা, সাফিন উজ জামান, শাকিব আহমেদ রাজ, ইরাতফা বিনতে রেদোয়ান ইঝত্রা, মুনতাকিম মনন, সারোয়ার সাইদ, তোফায়েল আল মামুন, জারিন সাওজিয়া, জিনিয়া জাফরিন খান, আনিসুল ইসলাম, জান্নাতুল ফেরদৌস তিশা, তানভীর নেওয়াজ তীর্থ, নাসিফ, সানজিদা ইসলাম লাবণ্য ও শিশির কুমার দত্ত।

পথনাটক ‘এসো ফিরি আলোর পথে’ এর প্রদর্শনীতে হাজারো দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পাশাপাশি ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।